ছবি : বহুমাত্রিক.কম
সাভার : শরীরে ইট পাথরের শক্ত আঘাত, আর কোমল চামড়ায় লোহা রডের রক্তক্ষরণ আঁচড়। সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধ্বসের বিভীষিকার এমন আধারে কেউ হেরেছেন, কেউ বেঁচে ফিরেছেন। বেঁচে ফেরা হাজারো শ্রমিক, শরীরিক প্রতিবন্ধকতা ও নানা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার আরেক জীবন যুদ্ধ পার করছেন।
২৪ এপ্রিল ২০১৩। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। সাভারের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রানা প্লাজার নয়তলা বিশিষ্ট ভবনে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশ করে। কিন্তু তারা জানতেন না, কী ভয়াবহ পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়।
বিদ্যুৎ যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই ভবনে থাকা অর্থাৎ সকাল ৮ টা ৪৭ মিনিটে একযোগে চালু করা হয় ডজন খানেক জেনারেটর। জেনারেটর চালু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধসে পড়ে ভবনটি। সরকারী হিসাব অনুযায়ী ধ্বস স্তুপের নিচে চাঁপা পড়ে প্রাণ হারান প্রায় ১১শ ৩৪ জন শ্রমিক এবং আহত হয় কমপক্ষে আরো ২ হাজার ৪শ ৩৮ জন হতভাগা শ্রমিক।
আগামীকাল ২৪ এপ্রিল ২০১৮। রানা প্লাজা ধ্বসের ৫ বছর পূর্ণ হবে। শিল্প দূর্ঘটনার ইতিহাসে কালো অধ্যায় এ দিনটি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় দূর্ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি।
রানা প্লাজার ভবনটির ১ম ও ২য় তলায় ছিল বিপনী বিতান। আর ৩য় থেকে ৯ম তলা পর্যন্ত ছিল ৫টি পোশাক কারখানা। ভবন ধ্বসের সাথে সাথেই ধ্বংস্তুপের নিচে আটকা পড়ে কয়েক হাজার শ্রমিক।
আটকে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার জন শ্রমিককে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হলেও প্রায় ১ হাজার ১৩৮জন শ্রমিক মারা যায়। আর যারা সে দিন এই ধ্বংস্তুপ থেকে বের হয়ে বেচে আছেন তারা আজ ভবন ধ্বসের ৫ বছর অতিক্রম করতে পারলেও ভুলতে পারেনি সেদিনের ভয়াল স্মৃতির কথা।
দেশের মানুষ এত বড় ভবন ধ্বসের ঘটনা এর আগে কখনও দেখেনি। ভবন ধ্বসের ৫ বছর অতিক্রম হলেও অনেক নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহত শ্রমিকরা পায়নি প্রয়োজনীয় আর্থিক ক্ষতিপূরণ। যার ফলে এখানো অনেক আহত শ্রমিক অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিয়ে আজও ফিরতে পারেনি স্বাভাবিক জীবনে। তবে কয়েকজন এরই মধ্যে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। অনেকেই মুদি দোকান দিয়ে কোন মতে জীবন চালাচ্ছেন।
তেমনই এক হতভাগা শ্রমিক নিলুফা বেগম। রানা প্লাজার ওই ভবনের একটি পোশাক কারখানায় চাকুরী করতেন তিনি। রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় সে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। পঙ্গু জীবন নিয়ে এখন সে চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি জানান, ‘আমার জীবনের এখন কোন দাম নেই। এ জীবন থাকার থেকে মরে যাওয়া অনেক ভাল। চিকিৎসার জন্য মাত্র তিন লাখ টাকা পেয়েছি। কিন্তু আমার চিকিৎসার খরচ হয়ে গেছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। অল্প টাকা পা ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু কি হল।’
তিনি জানান, ‘আমার আর ক্ষতি পূরণ লাগবো না। আমরা শুধু রানার বিচার চাই। আমারা ছেলে-মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন অতিবাহিত করছি আর রানা প্লাজার মালিক আরাম আয়েশে থাকছে। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
নিলুফা জানান, ‘চা-পানের দোকান দিয়ে কোন মতে দিনাতিপাত করছি। একটি ছেলে পড়াশোনা করছে। ঠিক মত তার পড়াশোনার খরচ দিতে পারিনা। অতিকষ্টে ছেলের বাবা একবেলা রিকশা চালিয়ে যা পায় আর আমি চা বিক্রি করে যা পাই তাই দিয়ে কোন রকমে চলছি। এটাকে চলা বলে না। এর থেকে মৃত্যুও ভাল। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। একদিন ওষুধ না খেলে প্রচন্ড যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। আজ ১৫ দিন ধরে ওষুধ খেতে পারছিনা। এ কষ্ট আর সহ্য হয়না।’
এ ব্যাপারে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এর সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু জানান, রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় এখনো অসংখ্য শ্রমিক যারা আছে, তারা মানুষিক বিকারগ্রস্থ হয়ে গেছে, শারীরিক অসুস্থ হয়ে আছে। আমরা বার বার সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, সাভারের রানা প্লাজার সামনে অথবা আশে পাশে কোথাও একটি স্থায়ীভাবে মেডিক্যাল ক্যাম্প করার জন্য। যে মেডিক্যাল ক্যাম্পের মাধ্যমে রানা প্লাজা দূর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা। সেই সাথে ২৪ এপ্রিলকে শ্রমিক শোক দিবস হিসাবে ঘোষণার দাবিও করেন এই শ্রমিক নেতা।
বহুমাত্রিক.কম