শুদ্ধ বাংলা ভাষা শুধু অফিসের ফাইল বন্দী। বাস্তবে কোথাও নেই শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুদ্ধ বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করলেও দৈনন্দিন জীবনে কোথাও নেই শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার। রচনার শিল্পগুণ তো দুরের কথা, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা, ভাষার আকর্ষণীয় মাধুর্য্য, শৈল্পিক সৌন্দর্য, নিপুণতা ও সাবলীল ব্যবহারও করছেনা কেউ।
শিক্ষিত হওয়ার পরও আঞ্চলিক ও অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার প্রবণতা বেড়েই চলছে। আবার একাডেমিক ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে, অফিসে, কর্মক্ষেত্রে, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন কথোপকোথনে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার নেই একটুও। এমনকি সুধী সমাবেশ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বক্তব্যেও অশুদ্ধ বা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমে প্রচারিত সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপন, টকশো ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চলছে আঞ্চলিক ভাষার মহা উৎসব।
দিন দিন এগুলো বাড়ছেই। এসব দেখে নব প্রজন্ম ও বিভিন্ন দেশের নাগরিক বাংলা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হচ্ছে এবং আকর্ষণ হারিয়ে বাংলা বিমুখ হচ্ছে। ফলে সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা বিকশিত হচ্ছেনা। তবে এটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষার প্রতি করণীয় ও ব্যবহারের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা ।
তারা জানিযেছেন, ইংরেজি ভাষার বর্ণমালার লিখনি, প্রয়োগ ও ব্যবহারে যে সুগভীরতার ছোয়া দেয়া হয়, বাংলাভাষার ক্ষেত্রে সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি আজও। অথচ আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা লিখনিতে সৌন্দর্য্য বর্ধন, আধুনিকতা ও আকর্ষনীয় করে অফিসে, কর্মক্ষেত্রে, বক্তৃতায়, দৈনন্দিন কথোপকথনে ও গণমাধ্যমে শুদ্ধ বাংলাভাষা ব্যবহার করলে, বাংলাভাষা আকর্ষণীয় হবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। প্রশংসিত হতে থাকবে বিশ্ব দরবারে।
সম্প্রতি আমাদের দেশের ছেলে-বুড়ো সবারই একটি কালচারে পরিণত হয়েছে আঞ্চলিক ভাষায় কথাবলা। শুধু তাই নয় তারা দাম্ভিকতায় বলছে, এভাবে কথা বলাটা বংশ বা খান্দানি পরিচয়। চলছে টিভি এবং রেডিওতেও। এসব কান্ড দেখে শুধু বিদেশীরা নয়, নিজ দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষদেরও কথা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক বিদেশীরা আগ্রহী হয়ে বাংলাভাষা শিক্ষার ইচ্ছা থাকলেও পাঠ্য বইয়ের শব্দের সাথে চলমান ও প্রচলিত কথাবার্তার মিল না পাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে বাংলা ভাষার প্রতি। এতে করে হারিয়ে যাচ্ছে ভাষার প্রাণ ও মর্যাদা। অবহেলিত হচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা। যা আমাদের অবিস্মরণীয় অর্জনকে সন্ধান করছে। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে শুদ্ধ বাংলাভাষার চর্চা, যথাযথ প্রয়োগ ও সর্বত্র শুদ্ধভাবে কথা বলা একান্ত প্রয়োজন।
অন্যথায় এভাবে আঞ্চলিক ভাষার বেড়াজালে চলমান বাংলাভাষার ব্যঙ্গাত্মক ব্যবহারে আবহেলিত হতে পারে বাংলা ভাষার উপযুক্ত মর্যাদা। তাই বাংলাভাষার স্থায়িত্ব, মর্যাদা ও নান্দনিকতা রক্ষার্থে অবিলম্বে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা এখন সময়ের দাবি।
সকলেরই মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীতে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার দৃষ্টান্ত বিরল। একমাত্র বাঙ্গালী জাতিই বুকের রক্ত দিয়ে বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাও আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে। যা আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সারাবিশ্বে বাংলাভাষা আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। জাতীসংঘে বাংলাভাষার অবস্থান চতুর্থ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সকল জাতী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে বাংলাভাষা আজ অনুকরণীয় ও বরণীয়।
এতসব সাফল্য কিন্তু একদিনে আসেনি। এর পিছনে রয়েছে দীর্ঘ দিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিসর্জন। দেশ বিভক্তের পর ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে অকাতরে দিতে হয়েছে বুকের রক্ত। অবশেষে ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেরা তাদের প্রানের বিনিময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে মায়ের মুখের ভাষা। তাই বলা যায় ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠায় বাঙ্গালী জাতীর ভুমিকা শ্রেষ্ঠত্বের। বিধায় ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার সেই মহিমাম্বিত ২১ শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে। কিন্তু এতকষ্টের বিনিময়ে যে বাংলাভাষা আজ বিশ্বের সর্বত্র অনুকরণীয়। সে বাংলা ভাষাকে আরও সৌন্দর্য, সমাদৃত ও আকর্ষনীয় করার নেই কোনই উদ্যোগ। দেখা যায় ভাষাকে সৌন্দর্য ও আকর্ষনীয় করা তো দুরের কথা, শুদ্ধ উচ্চারণ ও চর্চার অভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার আজ হয়ে পড়ছে অবহেলিত।
লেখক : সাংবাদিক
বহুমাত্রিক.কম