ছবি : বহুমাত্রিক.কম
সাভার : নিরপারাধ হয়েও গ্রেপ্তার। টাকা দিয়েও মুক্তি মেলেনি, উল্টো রিমান্ডে সয়েছেন নির্যাতণ। পরিবারের কাকুতি মিনুতি। সম্মান বাঁচাতে রাতভর আহাজারি। কোন যুক্তি, কোন প্রমাণই কাজে আসেনি।
গণধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী করে আদালতে রিমান্ড চেয়ে পাঠিয়ে দিলেন। দুইদিনের রিমান্ডও মঞ্জুর হয়। তখনও একি আহাজারি, আমি নির্দোষ। কে শোনে কার কথা। রিমান্ড শেষে জেল হাজতে। দীর্ঘ সময় পর জামিন পাই। এমনভাবেই নিজের কথা জানালেন সাভারের আশুলিয়ার আউকপাড়া গ্রামের ভুক্তভোগী রাজ্জাক সিকদার।
অভিযোগ উঠেছে, টাকা হাতিয়ে নিতে ও কম সময়ে নিজের কৃতিত্ত্বের অর্জন দেখাতে গিয়ে মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা নিরাপরাধ ব্যক্তিকে বানিয়ে দিলেন গণধর্ষণ মামলার আসামী। লোক লজ্জায় বাকরুদ্ধ ভুক্তভোগী পরিবারটি কি মুক্তি পাবে অসম্মানের গ্লানি থেকে।
ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, আশুলিয়ার আউকপাড়া গ্রামে রাজ্জাক নামে দুই ব্যক্তি।
রাজনীতিতে জড়িত বলে এই রাজ্জাক সিকদার এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত মন্ত্রী রাজ্জাক নামে। অপরজন হোটেল ব্যবসা করেন বলে ডাকেন তাকে হোটেল রাজ্জাক। কথা আছে, নামে নামে জমে টানে।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক শামীম হাসানের খাম খেয়ালীতে জমের টের পেলেন নিরাপরাধ মন্ত্রী খ্যাত রাজ্জাক। প্রত্যেক্ষদর্শী ও সাক্ষীদের উপেক্ষ করে হোটেল রাজ্জাক গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত হলেও গ্রেপ্তার করেন মন্ত্রী রাজ্জাকে।
মামলার পূর্বের তদন্তকারী ও আশুলিয়া থানার সেই পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত)শামীম হাসান বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন শরীয়তপুর জেলায়। তারপর ভাগ্য খুলে নিরপারাধ রাজ্জাক সিকদারের। মামলার দায়িত্ব নেন নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম। তারপরই তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মামলার অভিযোগ ও নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, গত বছরের ৮ই আগষ্ট আশুলিয়ায় দোসাইদে গণধর্ষণের শিকার বাউল শিল্পী গণধর্ষনের শিকার হন। ৯ আগষ্ট অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামী করে আশুলিয়ায় থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী তরুণী। সেই রাতে পূর্বের তদন্ত কর্মকর্তা শামীম হাসান মন্ত্রীখ্যাত রাজ্জাকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করেন। প্রায় ৪৪ জেলহাজতে থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে।
তদন্ত আশুলিয়ার দোসাইদের আদর্শপাড়া গ্রামের এই বাড়িতে গণধর্ষণের শিকার ঐ নারীকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় উদ্ধার করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার সাক্ষীরা দাবী, উদ্ধার হওয়া নারী সেসময় কয়েকজনের নামসহ হোটেল রাজ্জাকেই দায়ী করেছিলেন। তবু কেন মন্ত্রী রাজ্জাক গ্রেপ্তার। এদিকে সুযোগ নিতে ভুল করেননি অপরাধীর তালিকায় থাকা হোটেল রাজ্জাক। ইতিমধ্যে তার নাম ঠিকানা এমনকি ছবি গায়েব করে ফেলেছেন তিনি। হোটেল রাজ্জাকের ভাড়া বাড়ি গিয়েও পাওয়া যায়নি।
নাম না প্রকাশের শর্তে এলাকাবাসী কয়েকজন জানান, মন্ত্রী রাজ্জাকের টাকা পয়সা আছে, আর হোটেল রাজ্জাক মিয়া দরিদ্র। ফলে টাকা হাতিয়ে নিতে মন্ত্রী রাজ্জাক বলির পাটায় বানায় তদন্ত কর্মকর্তা শামীম হাসান। এমনকি মামলার অন্য আসামীদের ও চাপ সৃষ্টি করে মন্ত্রী রাজ্জাককে সনাক্ত করার জন্য।
ভুক্তভোগী রাজ্জাক সিকদার জানান, নিরপারাধ জেনেও সম্মান বাচাতে টাকা দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে আমার পরিবার। আমার বড় ছেলে জুয়ের ও বাড়ির ভাড়াটিয়া স্বপন নামে একজনকে নিয়ে গ্রেপ্তার রাতে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা তুলে দেন। পরদিন সকালে বাকী ১০ হাজার টাকা স্বপনের মাধ্যমে পৌছে দেয়া হয়। কিন্তু রেহাই মেলেনি। উল্টো রিমান্ডে এনে নিযাতন করেছেন। প্রায় দেড় মাস পর জামিনে বের হয়েছি। আমি আমার পরিবার লোক লজ্জায় বাড়ি বাইরে বেরুতে পারি না। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন আমাকে অব্যহতি দেয়া হবে। কিন্তু আমার এই অপুরনীয় ক্ষতি কি আর পুরন হবে। এ ঘটনায় সুষ্ট তদন্ত চাই ও আমাকে হয়রানিমুলক ও মিথ্যা মামলা জড়ানোর জন্য কর্মকর্তা বিচার দাবী করছি কর্তৃপক্ষের কাছে।
এ বিষয়ে রাজ্জাক সিকদারের প্রতিবেশী স্বপন জানান, শামীম স্যারের দাবী মতো টাকা পৌছে দিয়েছি। তবু তিনি রাজ্জাক সিকদারকে ছাড়েনি।
এ মামলার অন্য আসামী বর্তমানে জামিনে থাকা আতাউর রহমান অভিযোগ করে বলেন, গ্রেপ্তারের রাতে চাপ সৃষ্টি করে মন্ত্রী রাজ্জাকে সনাক্ত করতে বলেন শামীম স্যার। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। উল্টো স্যারকে বলেছি, নিরপারাধ ব্যক্তিকে আমি সনাক্ত করতে পারবো না।
প্রত্যেক্ষদর্শী ও মামলার সাক্ষী ছালেহা বেগম জানান, অসুস্থ অবস্থায় ভুক্তভোগী নারীকে যখন উদ্ধার করা হয়। তখন কয়েকজনের নামের সঙ্গে হোটেল রাজ্জাকের নামও অভিযোগ তুলেন। কিন্তু পরে শুনি অন্য রাজ্জাক অর্থা নিরপারাধ মন্ত্রী রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আমরা পুলিশ বিষয়টি জানিয়েছি কিন্তু কি হলো বুঝতে পারলাম না।
প্রত্যেক্ষাদর্শী ও উদ্ধারকারী বাবুল মিয়া জানান, ভুক্তভোগী তরুণী হোটেল রাজ্জাকের কথা অভিযোগ তোলেন। এছাড়া যেই ঘরটি গণধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে হোটেল রাজ্জাক কাজ করতো ও বসাবাস ছিলো। কিন্তু মন্ত্রী খ্যাত রাজ্জাক এই এলাকায় আসেন না।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার খালেক হোসেন ও এলাকাবাসী আতঙ্গের কথা জানিয়ে বলেন, পুলিশ যদি এভাবে তদন্ত না করে আসামী গ্রেপ্তার করে, তাহলে আইনের প্রতি আস্থা কমে যাবে। কোন ঘটনা ঘটলেই আতঙ্গ থাকবে। তাই নিরাপরাধ ব্যক্তিরা যেন শান্তি না পায় সেই দাবী সরকারের কাছে আমরা তুলে ধরছি।
এ ঘটনাকে আরও শক্ত করতে মমলা নামে নারীকে ভয় দেখিয়ে সেলিনা বানিয়ে আসামী করার অভিযোগ করেন একই মামলায় ভুক্তভোগী আরেক নারী।
মমলা ওরফে সেলিনা বেগম জানান, আমাকে গ্রেপ্তার করে ভয় দেখিয়ে জবান বন্ধি নিয়েছে পুলিশ শামীম স্যার। এসব কথা বললে ছেড়ে দিবে। না হলে পাইপ ডুকিয়ে দিবে, গরম ডিম দিবে। তাই ভয়ে তিনি আমাকে যা বলতে বলেছেন আমি তাই তাই বলেছি।
এ বিষয়ে মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি রাজ্জাক সিকদারকে সনাক্ত করেনি। আমি তদন্ত কর্মকর্তা শামীম স্যার বলেনি যে, রাজ্জাক সিকদার জড়িত আছে।
এ বিষয়ে বদলি হওয়া পুলিশ পরিদর্শক শামীম হাসান মুঠোফোনে তার সাফাই গেয়ে দাবী করেন, বাদীর শনাক্তের ভিত্তিতে মন্ত্রী রাজ্জাক গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। যখন বলা হয় নতুন তদন্ত কর্মকর্তা এ ধরণের কোন সাক্ষ্য প্রমাণ মন্ত্রী রাজ্জাকের বিরুদ্ধে পায়নি। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনিই আবার বলেন, সাক্ষ্য প্রমান না পেলে বাদ দেয়ার জন্য। বাদী বলছে তিনি শনাক্ত করেনি, তাহলে গ্রেপ্তার করা হলো কেন? তিনি বলেন, তখন তো বাদী বরেছিলো। এ ছাড়া টাকা নেয়ার বিষযটি তিনি অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম জানান, আমার তদন্তে যে তথ্য প্রমান পেয়েছি, সেভাবেই ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি। ফলে গত ডিসেম্বরে মন্ত্রী খ্যাত রাজ্জাককে এই মামলা থেকে অব্যহতি দেয়ার আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি অভিযুক্ত হোটেল রাজ্জাককে মামলায় আসামীর তালিকায় সংযুক্ত করা হয়েছে। আগের কর্মকর্তার তদন্ত বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাঈদুর রহামন জানান, তদন্ত করে নিরাপারাধ ব্যক্তি মামলা থেকে বাদ দিয়ে প্রকৃত আসামীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি তদন্ত গাফালতির প্রমান পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোন অভিযোগ পাওয়ানি বলে জানান তিনি।
বহুমাত্রিক.কম