ঢাকা : দেখতে অবিকল ভিনগ্রহীদের মতো ।মাথাটা তিন কোণা। মাথার দু’পাশ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে খুব বড় বড় দু’টি চোখ। যেন দু’টি চোখ দিয়েই সে গিলে খাবে সব কিছু! যেন সে ‘সর্বভূক’! ভিনগ্রহীদের ছবি দেখলে আমাদের যেমন পিলে চমকায়, ঠিক তেমনই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এই ‘ভিনগ্রহী জীব’দের দেখলে!
এরা আদতে ১০ কোটি বছর আগেকার একটি পতঙ্গ। এমন পতঙ্গের সন্ধান এর আগে পাওয়া যায়নি আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে। মায়ানমারের হুকুয়াং উপত্যকার খনি এলাকার ঘন জঙ্গলে গাছের ছালের ভেতর থেকে মিলেছে ওই হারিয়ে যাওয়া ‘ভিনগ্রহী জীবে’র ফসিল। তার খোঁজ মিলেছে দুর্মূল্য রত্নের মধ্যেও। খুব ছোট্টখাট্টো চেহারার এই নারী পতঙ্গের কোনও ডানা নেই। এরা মূলত গাছের ছাল বা কান্ডের ফাটলের মধ্যেই থাকে।
পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত যে ১০ লক্ষ প্রজাতির পতঙ্গের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে, আর তাদের
যে ৩১টি গোত্র (অর্ডার) রয়েছে, তার একটিরও সঙ্গে চেহারায়, চরিত্রে, গোত্রে, বংশপরম্পরায় মেলে না এই সদ্য আবিষ্কৃত প্রজাতির পতঙ্গটির। একেবারেই অভিনব এই পতঙ্গটির জন্য পতঙ্গ-কূলে একেবারে নতুন একটি গোত্র বা শ্রেণি (অর্ডার) বেছেছেন বিজ্ঞানীরা। যার নাম- ‘ইথিওকেয়ারনোডিয়া’ (Aethiocarenodea)। তবে সেই গোত্রে পড়া এই প্রজাতির পতঙ্গের বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে- ‘ইথিওকেয়ারনোডিয়া বুরমানি আমেরিকার ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির পতঙ্গবিদ্যার এমেরিটাস অধ্যাপক জর্জ পয়েনারের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল ওই আদ্যোপান্ত নতুন গোত্র বা শ্রেণি (অর্ডার) আর নতুন প্রজাতির (স্পেসিস) ওই পতঙ্গের সন্ধান পেয়েছেন।
ওই গবেষকদলে রয়েছেন এক অনাবাসী ভারতীয় পতঙ্গবিদ। অরবিন্দ সত্যানন্দন। তিনিও ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির পতঙ্গবিদ্যার অধ্যাপক। গবেষণাপত্রটি একেবারে হালে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ক্রেটাশিয়াস রিসার্চ’-এ। থাকার জায়গা বা খাদ্যের অভাবেই ১০ কোটি বছর আগে এই বিরল গোত্র ও প্রজাতির পতঙ্গরা বিলুপ্ত হয়ে যায় বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
এই সদ্য আবিষ্কৃত পতঙ্গটির অভিনবত্ব কোথায়?
প্রশ্নের জবাবে ওহায়োর ক্লিভল্যান্ড থেকে জন্মসূত্রে ভারতীয় পতঙ্গবিদ অরবিন্দ সত্যানন্দন ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘এই নতুন গোত্র আর প্রজাতির পতঙ্গটির এমন বেশ কয়েকটি গঠন-বৈচিত্র্য রয়েছে, যা এতাবৎ হদিশ মেলা কোনও পতঙ্গ-প্রজাতির মধ্যেই দেখা যায়নি। প্রথমত, এর তিন কোণা মাথা। যা অবিকল ওই ভিনগ্রহীদের যে ছবি আমরা কল্পনা করেছি, ঠিক তার মতোই।
দ্বিতীয়ত, তাদের মাথার দু’পাশে রয়েছে একেবারে কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা দু’টি চোখ। ছবিতে ভিনগ্রহীদের চোখ দু’টিকে আমরা যেমন দেখি, ঠিক সেই রকমই। এখনও পর্যন্ত যে সব গোত্র বা শ্রেণি ও প্রজাতির পতঙ্গের অস্তিত্বের হদিশ পেয়েছি আমরা, তার কোনওটার মধ্যেই পড়ে না এই সদ্য আবিষ্কৃত পতঙ্গটি। মাথার দু’পাশে ওই পতঙ্গদের চোখ দু’টি ছিল এমন ভাবে, যাতে মাথাটা এক পাশে ঘোরালেই তারা ১৮০ ডিগ্রি কোণ এলাকার সবটুকুই দেখতে পেত।’’
মূল গবেষক আমেরিকার ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির পতঙ্গবিদ্যার এমেরিটাস অধ্যাপক জর্জ পয়েনার তাঁদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘এই প্রজাতির আরও একটি পতঙ্গের ফসিলেরও হদিশ মিলেছে খুব সম্প্রতি। আর সেটাও পাওয়া গিয়েছে মায়ানমারে গাছের ছালের ভেতরেই। অথচ, পতঙ্গদের সবচেয়ে বড় গোত্র বা শ্রেণি ‘কোলিওপটেরা’র মৌমাছিরা রয়েছে প্রায় কয়েকশো’ প্রজাতির।’’
কী কী খেয়ে বাঁচতো এই অবিকল ভিনগ্রহীদের মতো দেখতে আদিমতম পতঙ্গরা?
পতঙ্গবিদ্যার অধ্যাপক সত্যানন্দন ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘আমাদের মনে হয়েছে, এরা যে সময় বেঁচেবর্তে ছিল, সেটা আদতে ডাইনোসরের যুগ। এরা একাধারে ছিল শাকাহারী ও মাংসাশী। কৃমি, শৈবাল, ছত্রাক খেয়ে এরা বাঁচতো।’’
কেমন ছিল এদের শরীরটা?
সত্যানন্দন বলছেন, ‘‘এদের দেহটা ছিল লম্বা। সরু। আর চ্যাপ্টা। খুব সরু সরু কিন্তু লম্বা পা ছিল এই পতঙ্গদের। এই পতঙ্গরা খুব তরতরিয়ে চলতে-ফিরতে পারতো। এমনকী, মাথার পিছনে থাকা কোনও বস্তুকেও দেখতে পারতো, মাথাটা একটু কাত করলেই দৃষ্টিশক্তি ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘোরাতে পারতো বলে।’’
শত্রুদের হানাদারি থেকে বাঁচতো কী ভাবে এই পতঙ্গরা?
পয়েনার তাঁদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘এদের গলায় একটি গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি ছিল। যেখান থেকে বেরিয়ে আসতো তরল জেলির মতো রাসায়নিক পদার্থ। আর তাতেই জব্দ হয়ে যেত ওই পতঙ্গের হানাদাররা।’’-আনন্দবাজার পত্রিকা