Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

হাওরের মাছে মড়ক : উদ্বেগে মৎসজীবিসহ সাধারণ মানুষ

জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০২:৩৯, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ০৩:২৬, ২৪ এপ্রিল ২০১৭

প্রিন্ট:

হাওরের মাছে মড়ক : উদ্বেগে মৎসজীবিসহ সাধারণ মানুষ

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলগুলো মৎস্য সম্পদে ভরপুর ছিল। এখন সেখানে মড়ক দেখা দেওয়ায় উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ করছে। সম্প্রতি হাওরাঞ্চলে বোরো ধান পাহাড়ী ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার। এরপর তা পঁচে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টির কারনে মৎস্য সম্পদে ভরপুর এ জেলায় মাছ মরতে শুরু করেছে, বাতাসে দুর্গন্ধ নষ্ট করছে পরিবেশ।

জেলার নদ-নদী তলিয়ে যাওয়া কয়েক সাপ্তাহের ব্যবধানে হাওরের কাঁচা ধান পানিতে পচে দূর্গন্ধ ও বিষাক্ত হয়ে মিঠা পানির মাছ ভেসে উঠছে। এই বিষাক্ত মাছ খেয়ে অনেকেই অসুস্থ হচ্ছেন। এর ফলে হাওর পাড়ের হাজার হাজার মৎস ও কৃষক পরিবার গুলোর উপর বিরুপ প্রভাব পরছে। এসব দেখে হাওর পাড়ের সচেতন মানুষের মাঝে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা বিরাজ করছে।

বোরো ফসল হারিয়ে কৃষকরা হাওরে মাছ ধরেই এবার বাঁচার স্বপ্ন দেখছিল তখনেই শুরু হল মাছের মরক। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। কৃষকের সব স্বপ-আশা এবার যেন শেষ করতেই এমন দুর্যোগ শুরু হয়েছে হাওর পাড়ে বলছেন হাওর পাড়ের মৎসজীবিরা।

মাছের অস্বাভাবিক মড়কের কারণ খতিয়ে দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল কাজ শুরু করেছে। তারা প্রাথমিক ভাবে ৪টি কারণ শনাক্ত করেছেন সেগুলো হল, পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়া,অ্যামোনিয়া গ্যাস বৃদ্ধি,অ্যাসিডিটির প্রভাব ও কীটনাশক।

গত শনিবার সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন হাওরে পানি-মরা মাছ সহ জলজ জীব ও উদ্ভিদ প্রজাতির পরীক্ষ-নিরীক্ষা করা শুরু করেছেন তারা। এর আগে গত শুক্রবার হাওরের পানি ও মাছ পরীক্ষা করে গেছে বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর-এর ইসতিয়াক হায়দার (রাসেল), মোঃ আশিকুর রহমান ও মাসুদ হোসেন খাঁন ৩ সদস্যের বিজ্ঞানী দল জেলার বিভিন্ন হাওরের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবালী পরীক্ষা করেন।

প্রতিনিধি দলের মুখ্য বৈজ্ঞানীক কর্মকর্তা ডাঃ মাসুদ হোসেন খাঁন বলেন, ডুবে যাওয়া বোরো ধানের জমিতে থাকা কাচাঁ ধান পচেঁ পানি দূষিত হয়েছে। এর ফলে পানিতে অস্বাভাবিক হারে হাইড্রোজেন সালফাইট ও এমোনিয়া গ্যাস তৈরী হওয়ায় কারণে পানির অক্সিজেনের মাত্র কমে গেছে। এছাড়াও মাছের ফুলকায় ময়লা জমে থাকা একটি কারণ হতে পারে। মাছের স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য পানিতে যেখানে ৫-৭ পিপিএম অক্সিজেন থাকার কথা সেখানে হাওরের দূষিত পানিতে ২-৪ পিপিএম অক্সিজেনের অভাবে মাছ ভেসে ওঠেছে। তাহিরপুর উপজেলার বিভিন্ন হাওরে অক্সিজেনের পরিমাণ কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। কিন্তু অন্যান্য হাওরে বেশি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সঠিক ভাবে তথ্য জানানো যাবে। হাওরে মাছ ও হাঁসের মড়কের জন্য ফসলের মাঠে ব্যবহার করা কীটনাশকও একটি কারণ বলে মনে করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক দল। তারা বলছেন, বন্যার পানি ফসলের মাঠ ডুবিয়ে দেয়ায় কীটনাশক ও এসিড ছড়িয়ে পড়েছে।

হাওরের পানি পরীক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আজমল হোসেন ভূঁইয়া জানান, অন্যান্য এলাকা থেকেও এসিডিটি ও কীটনাশক পানির সঙ্গে আসতে পারে। যার ফলে মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। ধানের পচা দুর্গন্ধ থেকে মানুষের শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে তবে এই সমস্য ক্ষনস্থায়ী।

জীববৈচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ আধার মাছের অভয়াশ্রম বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ও জলজ প্রাণী মারা গেলেও অন্য হাওরের তুলনায় তা অনেক কম। তবে হাওরের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব¡ দেওয়া খুবেই প্রয়োজন।

সরজমিনে বিভিন্ন হাওরে গিয়ে দেখা যায়, বিষাক্ত পানি খেয়ে কচ্ছপ, বাইম, বৌয়াল, ভূতিয়া, রুই, টেংরা, পুটি, গনিয়া, কালিয়া সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠতে দেখা গেছে। মাছ মরে ভেসে উঠায় জেলেরা আতংকে মাছ ধরা থেকে বিরত রয়েছেন।

হাওর পাড়ের কৃষক ও মৎস পরিবারের সদস্যরা জানান, এই বার ত সব শেষ হাওর গেল, গরু গেল অহন মাছ। এইবার আর বাঁচার উপায় থাকত না। না খাইয়া মরতে হইব।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনরে পক্ষ থেকে মাইকে সতর্ক বার্তায় সাধারণ জনগনকে মাছ না খাওয়ার জন্য পরামশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে পানি বিশুদ্ধ করে মৎস্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য আহ্বান জানান হাওর পাড়ের মানুষেরা।

হাওরাঞ্চলের মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, পূর্বে হাওরে প্রচুর পরিমানে মাছ পাওয়া যেত আমরাও বেচা-কেনা করে লাভবান হয়েছি। কিন্তু বর্তমানে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল জানান, বোরো ফসল ডুবে যাওয়ার পর এখন হাওরে পচাঁ দূর্গন্ধ আর হাওরের মাছে ভেসেঁ উঠছে। গুরুত্ব সহকারে দ্রুত প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যার জন্য বাজারে এখন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না পাঙ্গাস আর সিদঁল ছাড়া।

সুনামগঞ্জের হাওরের পানিতে এখন পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। তারা হাওরে পানিতে নেমে দীর্ঘক্ষণ তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করেন। প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন আনবিক শক্তি কমিশন প্রতিনিধি দল।

তারা জানিয়েছেন, ঢাকায় আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। রোববার সকালে সুনামগঞ্জের দেখার হাওর ও খরচার হাওরের পানি পরীক্ষা শেষে এ তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি দলের প্রধান ড.দিলীপ কুমার সাহা। আরও জানান, দেখার হাওর ও খরচার হাওরের পানিতে তেজস্ক্রিয়তার কোনো প্রমাণ মেলেনি। পরিবেশে স্বাভাবিকভাবে ০.২০ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তা থাকে সেক্ষেত্রে হাওরে রয়েছে ০.১০ যা প্রায় অর্ধেক।

উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের ৪৬টি হাওরে অসময়ে বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যাওয়া হাওরগুলো। এর মধ্যে জেলার কয়েকটি হাওরে মাছ মরে ভেসে ওঠে। হাওরে ধান পচে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাসে মাছে মড়ক লাগায় গত বৃহস্পতিবার থেকে সুনামগঞ্জের হাওরে আগামী এক সপ্তাহের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer