Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলনের শতবর্ষপূর্তি সোমবার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ১৪:৫৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

প্রিন্ট:

ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলনের শতবর্ষপূর্তি সোমবার

মৌলভীবাজার : বিগত শতাব্দীর প্রারম্ভে তৎকালীন ভারতবর্ষে বর্তমান বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নে ভানুবিলের মণিপুরী কৃষক প্রজাদের জমিদার ও বৃটিশবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয়।

গত শতকের প্রথম ও তৃতীয় দশকে পর্যায়ক্রমে সংঘটিত এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয়। বাংলার কৃষক ফিরে পায় জমিজমার উপর তার স্বত্ব। এলাকায় যে জমিদার বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল-সেটিই ‘ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলন’ নামে স্থানীয়ভাবে খ্যাতি লাভ করেছে। এই আন্দোলনের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে সোমবার ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলন সংরক্ষন পরিষদ আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলন সংরক্ষন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ভানুবিল এলাকাসহ এতদ্ অঞ্চলের ভানুবিল, ছনগাঁও, কোনাগাঁও, মাঝেরগাঁও, চিৎলীয়া, জাঙ্গালীয়া প্রভৃতি গ্রামসমূহ ছিল পৃথিমপাশার জমিদার আলী আমজদ খান এর অধীন। তৎকালীন সময়ের দলিলপত্রে গৌরহরি সিংহ তালুক উল্লেখিত হলেও পরবর্তী সময়ে পৃথিমপাশার জমিদার আলী আমজদ খান এই এলাকার জমিদার হিসেবে আখ্যায়িত হন।

গত শতাব্দীর প্রথম দশকে (১৯০১-১৯০৭) ঔপনিবেশিক শাসক পেয়েছিল বৃটিশদের পোষ্য পৃথিমপাশার জমিদার আলী আমজাদ খাঁ ও তার নায়েব রাসবিহারী দাশকে। জমিদার আর নায়েব মিলে কৃষকদের উপর চালায় অন্যায় জুলুম ও শোষন। রাসবিহারী রসিদ ছাড়াই খাজনা আদায় করতো। কৃষকরা হতবাক হয়ে দেখতে পায় হিসাবের খাতায় তাদের খাজনা পরিশোধের চিহ্ন ও দলিল নেই। জারী হয় শত শত প্রজার উপর প্রহসনের নোটিশ।

মণিপুরী কৃষকরা বাঙালি কৃষকদের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে এই বেইমানীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে একজন কৃষকও এগিয়ে আসেনি খাজনা দিতে। ফলে সংঘাত এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে রাসবিহারীকে হত্যা করা হলে তখনকার মতো মণিপুরী প্রজারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, কিন্তু পরোক্ষভাবে চলতে থাকে অন্যায় ও শোষনের ধারা।

বিশ শতকের ত্রিশের দশকে শাসকগোষ্ঠী আবার সেই পুরোনো চেহারায় আরো সতর্ক এবং দ্বিগুন নিষ্ঠুরতা চালায়। গোটা বিশ্বে তখন পুঁজিবাদের বিরোধ, সা¤্রাজ্যবাদের প্রকট রূপ, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের অভ্যুদয়, ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন।

১৯৩১ সালের দিকে শোষিত প্রান্তজনের বিদ্রোহের সাথে একিভূত হতে ভানুবিলের পঞ্চানন ঠাকুর, বৈকুন্ঠনাথ শর্মা, নাবদ্বীপ সিংহ, কাসেম আলী, গিরিন্দ্রমোহন সিংহদের সাথে যোগ দিলেন কংগ্রেস ও কমিউনিষ্ট পার্টির অনেক বিপ্লবী। দ্বারিকা গোস্বামী, নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী, পূর্ণেন্দু সেনগুপ্ত, চারুবালা দেবী প্রমুখ নেতাকর্মীর সক্রিয় অংশগ্রহনে ভানুবিলের কৃষকবিদ্রোহ মুলধারার সংগ্রামের মর্যাদা ও তাৎপর্য পায়। ভানুবিলের কৃষক আন্দোলনে মণিপুরী নারীদের অংশগ্রহন ও নেতৃত্বে শরিক হন মহিয়সী লীলাবতী শর্মা, সাবিত্রী সিংহ, শশীপ্রভা দে, যোবেদা খাতুন এমন অসংখ্য বিদ্রোহিনীর সদর্প পদক্ষেপে কেঁপে উঠে অত্যাচারীর ভাঙোনোন্মুখ দুর্গ। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে পুরুষদের সাথে সমানভাবে অংশনেয়া মনিপুরী নারীরা গর্জে উঠে। বৈকুন্ঠ শর্মার ষোল বছর বয়সি মেয়ে লীলা মণিপুরী চাষীদের মনে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতো।

শাসককুলের পরিবর্তনকালে জমিদার আলী আমজাদ খাঁর মৃত্যু ঘটলে তার পুত্র আলী হায়দার খাঁ আর তার নায়েব প্রমোদ ধর দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রাখে। জমির খাজনা বাড়িয়ে দেয়া হয় দ্বিগুন। পুকুর কাটা বা মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। নিজ ভিটায় গাছ লাগানোর অধিকারটুকুও হরন করা হয়।

তীব্র ক্ষোভে ফুঁসে উঠেও কংগ্রেসের তথাকথিত অহিংস নীতির ফরমান পালন করতে গিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা ও বিভৎসতার মুখামুখি হতে হয় মণিপুরীদের। কৃষকের ঘরবাড়ি লুট হতে থাকে, মেয়েদের ছিনিয়ে নেয়া হয়, হাতির পায়ে মাঠের ফসল মাড়িয়ে দেয়া হয়। জমিদারের পাগলা হাতিকে তাড়াতে নিজস্ব ঢাক করতাল শঙ্খ বাজিয়ে মণিপুরী কৃষক-কৃষানী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলে অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ফলে ভানুবিল পরিণত হলো রণভূমিতে। বহু কৃষক, সরকারী সৈন্য, পুলিশ হতাহত হলো। কৃষকের ঘরবাড়ি পুড়লো, ৭৫২টি ঘরের ৩০০টিই হাতি দিয়ে মাড়িয়ে দেয়া হলো। এরপর গণগ্রেফতারে বহুগ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে।

কৃষকদের এই প্রতিরোধ শুরু হতেই কংগ্রেস নেতারা আন্দোলনের দায় নিতে অস্বীকার করলেও কৃষকরা কংগ্রেস নেতৃত্বের শঠতার কাছে মাথানত না করে বিদ্রোহী কৃষকরা তাদের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। পরে দেশে বিদেশে ভানুবিলের কৃষকদের উপর সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠে। বৃটিশ পার্লামেন্টে খোদ লেবার পার্টি সরকারের সমালোচনায় ও নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। অবশেষে সফল কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দে সিলেট জেলা প্রজাসত্ত্ব আইন পাশ হয়। কৃষক ফিরে পায় জমিজমার উপর তার স্বত্ব। তাই ইতিহাসের দৃষ্টিকোন থেকে বিগত শতাব্দীর প্রারম্ভে ও তৃতীয় দশকে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়।

ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলন সংরক্ষন পরিষদ এর সভাপতি বাবুসেনা সিংহ বলেন, কয়েকটি সময়ে ঐতিহাসিক এই আন্দোলন চলে। সে হিসেব ধরেই সোমবার ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলনের শতবর্ষ পূতি পালন করা হচ্ছে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer