ফাইল ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের সবচেয়ে বড় লড়াই এখন শুরু হতে যাচ্ছে। বুধবার ট্রাম্প প্রশাসন মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ও ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, প্রশাসন যে শুল্ক আরোপ করেছে তার বেশির ভাগই অবৈধ এবং তা বাতিল করা উচিত। এমন আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিতে যাচ্ছে। একে বলা হচ্ছে ট্রাম্পের জন্য এসিড টেস্ট। কারণ, যদি আদালত আবেদনের পক্ষে রায় দেয়, তবে ট্রাম্পের পুরো বাণিজ্য কৌশল ভেঙে পড়বে। এপ্রিল মাসে ঘোষিত বৈশ্বিক শুল্কসহ তার নীতিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সরকারকে আমদানি শুল্ক হিসেবে আদায় করা কয়েক বিলিয়ন ডলার ফেরত দিতে হতে পারে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।
আবেদনের শুনানি ও রায় নিয়ে বিচারপতিরা মাসের পর মাস আলোচনা করবেন, তারপর ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। ট্রাম্প এই মামলাকে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার দাবি, যদি তিনি হেরে যান তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে এবং বাণিজ্য আলোচনায় তার হাত বাঁধা থাকবে। রবিবার ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি আদালতে নিজে উপস্থিত হবেন না। কারণ তিনি কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চান না। তিনি বলেন, আমি যেতে খুব চেয়েছিলাম। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের গুরুত্ব থেকে মনোযোগ সরাতে চাই না। এটি আমার ব্যাপারে নয়, এটি আমাদের দেশের ব্যাপার। ট্রাম্প আরও বলেন, যদি তিনি মামলায় জিততে না পারেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বহু বছর ধরে আর্থিক সংকটে ভুগবে।
শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, লার্নিং রিসোর্সেস নামের একটি মার্কিন খেলনা কোম্পানি জানায়, ২০২৫ সালে তাদের শুল্ক খরচ দাঁড়াবে ১৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের তুলনায় সাত গুণ বেশি। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিক উলডেনবার্গ বলেন, শুল্কের কারণে আমাদের ব্যবসা ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। জানুয়ারি থেকে শত শত পণ্যের উৎপাদন স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে।
জর্জিয়ার কো-অপারেটিভ কফিজ নামের একটি কফি আমদানিকারক কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল হ্যারিস বলেন, আমরা আশা করছি আদালত এটিকে অবৈধ ঘোষণা করবে। কিন্তু একই সঙ্গে বাস্তবতা মেনে নিতে প্রস্তুত হচ্ছি। তার কোম্পানি এপ্রিল থেকে প্রায় ১৩ লাখ ডলার শুল্ক পরিশোধ করেছে।
এই মামলার মূল প্রশ্ন হলো- প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে? আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রায় অনুমান করা কঠিন। যদি আদালত ট্রাম্পের পক্ষে রায় দেয়, তবে ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টরাও আরও বেশি নির্বাহী ক্ষমতা পেয়ে যাবেন। ট্রাম্প প্রশাসন ১৯৭৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ইকনমিক পাওয়ার্স অ্যাক্ট (আইইইপিএ) ব্যবহার করে শুল্ক আরোপ করেছে। আইনের অধীনে সংসদীয় প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট সরাসরি আদেশ দিতে পারেন। ট্রাম্প ফেব্রুয়ারিতে চীন, মেক্সিকো ও কানাডা থেকে পণ্য আমদানির ওপর কর আরোপ করেন। দাবি করেন, এ দেশগুলো থেকে মাদক পাচার ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’। এপ্রিল মাসে আবার তিনি প্রায় সব দেশের পণ্যের ওপর ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কর বসান।
এবার যুক্তি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি একটি অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত হুমকি। কিন্তু বিরোধীরা বলছে, আইনটিতে ‘ট্যারিফ’ শব্দটি উল্লেখই নেই। অর্থাৎ কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া প্রেসিডেন্ট কোনো কর আরোপ করতে পারেন না। দুই দলের শতাধিক কংগ্রেস সদস্য যুক্তি দিচ্ছেন, সংবিধান অনুসারে শুল্ক ও কর আরোপের ক্ষমতা কেবল কংগ্রেসেরই। দুই শতাধিক ডেমোক্রেট এবং একজন রিপাবলিকান (সিনেটর লিসা মুরকাউস্কি) সুপ্রিম কোর্টে যৌথভাবে একটি বক্তব্য জমা দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, জরুরি ক্ষমতার আইন প্রেসিডেন্টকে বাণিজ্য আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে শুল্ক আরোপের ক্ষমতা দেয় না। গত সপ্তাহে সিনেট প্রতীকীভাবে তিনটি প্রস্তাব পাস করেছে ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে। এর একটি ছিল তার ঘোষিত ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ বাতিল করা। তবে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে সেগুলো পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তিনটি নিম্ন আদালত ইতিমধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বুধবার শুনানি শুরু করার পর রায় দিতে আগামী জানুয়ারি বা জুন পর্যন্ত সময় নিতে পারে। রায়ের প্রভাব পড়বে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি শুল্কের ওপর, যা এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মোট শুল্ক আয়ের প্রায় অর্ধেক। যদি সরকারকে ফেরত দিতে হয়, তাহলে অনেক ব্যবসা ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবে।
কিন্তু ধাক্কা পুরোপুরি সামাল দেয়া কঠিন হবে। বিল হ্যারিস বলেন, এটি এমন এক মানসিক ও আর্থিক চাপ যা আগে কখনও দেখিনি। ব্যবসার প্রাণশক্তিই যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, যদি তারা মামলায় হেরে যায়, তবে অন্য আইনের অধীনে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ১৫০ দিনের জন্য আরোপ করতে পারে। তবে তাতে কিছুটা স্বস্তি পাবে ব্যবসাগুলো। কারণ সেক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত আনুষ্ঠানিকতা ও সময় লাগে। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ টেড মারফি বলেন, এ মামলার আসল বিষয় শুধু টাকার নয়, প্রেসিডেন্ট কোনো পূর্ব ঘোষণা বা পরামর্শ ছাড়াই রবিবারে শুল্ক ঘোষণা করেন, বুধবার থেকেই তা কার্যকর হয়। প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতেও কি এমনই চলবে?
মার্কিন শুল্ক নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জুলাইয়ে হওয়া চুক্তিও এখন ঝুলে গেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট জানিয়েছে, তারা সুপ্রিম কোর্টের রায় না আসা পর্যন্ত চুক্তি অনুমোদন করবে না। সুইজারল্যান্ড, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পণ্যে ৩৯ ভাগ শুল্ক বসিয়েছে, জানিয়েছে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। সুইস চকোলেট কোম্পানি শকলাঁ ক্যামিল ব্লোচ বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে কোশের চকোলেট রপ্তানি করে। তারা বলছে, নতুন শুল্কের কারণে তাদের মুনাফা প্রায় শূন্যে নেমে গেছে। কোম্পানির প্রধান ড্যানিয়েল ব্লোচ বলেন, যদি আদালত এই শুল্ক বাতিল করে দেয়, অবশ্যই আমরা তা ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখব। তবে আমরা নিশ্চিত নই, এতে সমস্যার পুরো সমাধান হবে কিনা।




