Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

পর্দার আড়াল সরাতেই বেরিয়ে এল লজ্জাবতী গ্রহ!

সুজয় চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

পর্দার আড়াল সরাতেই বেরিয়ে এল লজ্জাবতী গ্রহ!

ঢাকা : পর্দার আড়ালে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল পাক্কা ১৮টা বছর! সে মনে করে, পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখাটাই তার ‘ধর্ম’! সে বড়ই লাজুক! পর্দার আড়ালটা এ বার সরিয়ে দেওয়া গেল সেই লাজুক ‘ধার্মিকে’র!

পর্দার আড়ালটা আদতে তার ঘন, লম্বা একটা ছায়া। যে ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখা আছে তার কায়া! সেই ঘন আর লম্বা ছায়াই ছেয়ে রয়েছে তার মুখ ঘিরে থাকা গ্যাস আর ধুলোবালির চাকতিতে। প্রায় ৪ হাজার ১০০ কোটি মাইল চওড়া ওই চাকতি বা ‘প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক’টি ওই সৌরমণ্ডলের নক্ষত্রটি থেকে রয়েছে প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে।

পর্দার আড়াল সরাতেই দেখা গেল সেই লাজুক ‘ধার্মিকে’র মুখ। আদতে সে একটি ভিন গ্রহ। নাম তার- ‘হাইড্রা’। মহাকাশে হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপের চোখে শেষমেশ ধরা পড়ল তার মুখ। ১৮ বছরের লাগাতার চেষ্টার পর। আমাদের থেকে ১৯২ আলোকবর্ষ দূরের অন্য একটি সৌরমণ্ডলে। যে সৌরমণ্ডলের ‘সূর্য’ বা নক্ষত্রটির নাম- ‘TW-Hydrae’।

ওজনে যা আমাদের সূর্যের চেয়ে কিছুটা হাল্‌কা। তার বয়সও খুব একটা বেশি নয়। আমাদের সূর্যের বয়স যেখানে ৫০০ কোটি বছর, সেখানে ওই নক্ষত্র- ‘TW-Hydrae’-র বয়স মেরেকেটে ৮০ লক্ষ বছর। আমাদের সূর্যের মতোই ওই নক্ষত্রটিকে পাক মারছে পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখা ‘লাজুক’ ভিন গ্রহটি। তার ‘সূর্যে’র থেকে ১০ কোটি মাইল দূরের কক্ষপথে। তার মানে, আমাদের সূর্য থেকে যতটা দূরে রয়েছে পৃথিবী, ওই ‘লজ্জাবতী’ ভিন গ্রহটিও তার নক্ষত্র থেকে রয়েছে ততটাই দূরে।
আমাদের ঠিক পাশেই না-হলেও, ‘কাছের পাড়া’- ‘হাইড্রা’ নক্ষত্রপুঞ্জে। যার আরও একটি নাম- ‘ফিমেল ওয়াটার স্নেক’। সেই নক্ষত্রপুঞ্জে ওই সৌরমণ্ডলটির জন্ম খুব বেশি দিন আগে হয়নি। সেই অর্থে, এখনও কৈশোর, যৌবন কাটেনি ‘TW-Hydrae’ নামে ওই তারা বা নক্ষত্রটির।

পর্দার আড়াল সরিয়ে একেবারেই হালে এই ‘লজ্জাবতী’র হদিশ মিলেছে মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে ‘স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট’-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন ডেবেসের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল। যে গবেষকদলে রয়েছেন এক জন বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানীও। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুনন্দ মুখোপাধ্যায়। অধ্যাপক ডেবেস তাঁর গবেষণাপত্রটি গত ৭ জানুয়ারি পড়েছেন টেক্সাসে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বৈঠকে।

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে সুনন্দ নিউইয়র্ক থেকে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘নতুন ভিন গ্রহটি কিন্তু সেই ঘন, লম্বা ছায়া তৈরি করছে না। যে তারাটির (TW-Hydrae) চার পাশে সেই ভিন গ্রহটি চক্কর মারছে, তার থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাস, কণাস্রোত আর ধুলোবালিকে নিজের জোরালো অভিকর্ষ বলে কাছে টেনে আনছে গ্রহটি।

আর সেই গ্যাস, কণাস্রোত আর ধুলোবালির ঘন, পুরু চাদরটাকে তার মুখের ওপরে থাকা চাকতির ভেতরের অংশে নিজের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানেই ওই গ্রহটি জাপটে ধরে রাখছে। আর সেই চাকতিটিই তৈরি করছে ওই ঘন, লম্বা ছায়া। যা চাকতিটির বাইরের দিকেও ছড়িয়ে পড়ছে। গত ১৮ বছর ধরে আমরা সেই ছায়াটির ওপর নজর রেখে গিয়েছি।

২০০৫ সালেই প্রথম হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপের নজরে পড়ে যায় ওই সুবিশাল ছায়ার উজ্জ্বলতার বাড়া-কমা, তার বিভিন্ন দিকে। হাব্‌ল টেলিস্কোপের এটাও চোখে পড়ে, সেই বিশাল ছায়াটা সরে সরে যাচ্ছে। এখান থেকে ওখানে। ঘড়ির কাঁটা যে দিকে ঘোরে, তার উল্টো দিকে। তা কেন হচ্ছে, সেটা তখন বোঝা যায়নি। ছায়ার একটি বিন্দু ১৬ বছর আগে, ২০০০ সালে যেখানে ছিল, গত বছর সেই বিন্দুটিকেই ফিরে আসতে দেখা যায়। তার মানে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে ছায়াটি ঘুরছে, প্রতি ১৬ বছরে এক বার করে।

প্রথমে মনে করা হয়েছিল, এ সব ওই চাকতিরই (প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক) কারসাজি। কিন্তু ওই ছায়াটি খুব দ্রুত সরছে দেখে বোঝা যায়, তা চাকতির জন্য হচ্ছে না। কারণ ওই চাকতিটির বাইরের দিকটা এক বার ঘুরতে কয়েকটা শতাব্দী সময় নেয় বলে আমরা হিসেব কষে জানতে পেরেছি।

আর সেই ছায়াটিও এতটাই লম্বা যে, সেটা অন্তত ১ হাজার কোটি মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে, ওই ‘TW-Hydrae’ সৌরমণ্ডলে। যা একমাত্র সম্ভব, যদি সেই ছায়াটি সরে সরে যায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ওই ভিন গ্রহটি সেই ছায়াটিকেই তার পর্দা বানিয়ে নিয়ে তার মুখ ঢেকে রাখছে। পরে চিলির ‘আটাকামা লার্জ মিলিমিটার অ্যারে’ (‘আলমা’) টেলিস্কোপ দিয়ে ঠাওর করা যায়, ওই ছায়াটি তৈরি হচ্ছে ভিন গ্রহটির মুখের ওপরে থাকা চাকতিটির ভেতরের দিকে। আর সেটা তখনই সম্ভব, যদি চাকতিটির পিছনে মুখ লুকিয়ে রাখা কোনও গ্রহ তার জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে কোনও গ্যাস, কণাস্রোত ও ধুলোবালিকে জাপটে নিজের কাছে ধরে রাখে।’’

সুনন্দ বলছেন, ‘‘ওই ‘লজ্জাবতী’ ভিন গ্রহটি চেহারায় আমাদের সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির মতোই। তাই তার অভিকর্ষ বলও খুবই জোরালো। সেই জোরালো অভিকর্ষ বলই গ্যাস আর ধুলোবালির ঘন, পুরু চাদরের ছায়াটাকে জাপটে ধরে রাখতে সাহায্য করছে।’’

আনন্দবাজার পত্রিকা

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer