সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ফিরে ফিরে আসে প্রতিবছরের শারদীয় দূর্গা উৎসব। দূর্গা হলো মায়ের প্রতীক। দুর্গতিনাশিনী। দূর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুভ মহালয়ার মাধ্যম দিয়ে শুরু হয়।
তারপরে প্রথমা, দ্বিতীয়া এভাবে পঞ্চমী পর্যন্ত মূর্তি, প্রতিমা তৈরী ও সাজানোর কাজসহ পূজারাম্ভ পর্ব চলতে থাকে। আর পূজার মূল পর্ব শুরু হয় ষষ্ঠীর মাধ্যমে। পূজারাম্ভের ধারাবাহিকতায় একে মহাষষ্ঠী বলা হয়। এ মহাষষ্ঠীর আগপর্যন্ত পূজার যে প্রস্তুতি চলতে থাকে তার পরিসমাপ্তি হয় ষষ্ঠী শুরুর মাধ্যমে। এভাবে পূজা শুরু হওয়ার পরে সেটি সার্বজনীনতা লাভ করতে থাকে। কিন্তু করোনা মহামারিকালের এবারকার দুর্গাপূজাও পালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে।
বলা হয় সনাতন হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবে সকল পূজা-পার্বণের মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে বড় মহাযজ্ঞ। দুর্গা মা কখনো আসে ঘোড়ায় চড়ে। আবার কখনো বা আসে নৌকায় চড়ে।
পৌরাণিক কাহিনীর তথ্যমতে কথিত আছে, যেবার মা দুর্গা নৌকায় চড়ে আসে সেবার বেশি বৃষ্টি হয়। আবার যে বার মা দুর্গা ঘোড়ায় চড়ে আসেন সেবার বৃষ্টি কম হয় এবং গরম বেশি থাকে। এসময় গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া মহল্লা ও সারাদেশের শহর পর্যায়ে বিশেস পরিস্থিতিতে সীমিত আকারে তৈরী হয়েছে হাজারো পূজামন্পডপ।
আমাদের দেশ মূলত একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে যেমন আনন্দঘন মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দময় ঈদুৎসব পালিত হয় সার্বজনীনতায়। তেমনি পালিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী, মহররম আশুরাসহ অন্যান্য পবিত্র ধর্মানুষ্ঠান ও রীতিনীতি।
অপরদিকে একই সাথে কাছাকাছি সময়ে পালিত হয় হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ বড় দুর্গপূজা। আবার তার কিছুদিন পরেই পালিত হয় লক্ষী পূজা ও কালি পূজা। এখন মন্দিরে মন্দিরে চলছে প্রতিমা তৈরীর কাজ।
আজ দুর্গাপূজার ষষ্ঠী। দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় ষষ্ঠীতেই। তবে ষষ্ঠীপূজা অর্থাৎ বোদনের দিন থেকেই পূজা শুরু হলেও পূজার আসল আমেজ মানে ভিড় জমতে শুরু হয় সপ্তমী থেকে।
পূজার সময় সবচেয়ে বেশি আনন্দে মেতে উঠে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ান যেকোন ধর্মের লোকজন। সখ করে অনেকে দেখতে আসেন পূজা মণ্ডপগুলো।
টেলিভিশনের সংবাদসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ করে স্টার জলসাসহ ভারতীয় কিছু টিভি চ্যানেলের প্রতিদিনের ধারাবাহিক নাকটগুলোতে এসব পূজার অনুষ্ঠানাদি আগে থেকেই প্রচার পেতে থাকে।
সেজন্য আমার বাচ্চা ছেলেদেরও প্রতিবছর ময়মনসিংহ শহরের সবগুলো পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিস্তু এবার হয়তো এর ব্যতিক্রম হবে কারণ করোনা মহামারি। এটাকেই বলে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সার্বজনীনতা ও উদারতা। আর ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’- এ শ্লোগানটির যথার্থ সত্যতার প্রমাণ মিলে তখন।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা রীতিনীতি এভাবেই চলে আসছে। প্রতিবারই দেবী মর্ত্যলোকের বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন স্বর্গের শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে। দেবীর সঙ্গে থাকেন তার চার সন্তান। এঁরা হলেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধন-সম্পদের দেবী লক্ষী, কার্তিক ও সিদ্ধিদাতা গণেশ।
দেবীকে বরণ করার জন্য সবাই সমানভাবে উদগ্রীব থাকেন। ঘরে ঘরে নারিকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া বানাতে ব্যস্ত থাকেন মায়েরা। নতুন জামা-কাপড় কেনায় ব্যস্ত থাকেন সবাই। আর এসব যে শুধু হিন্দু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়। এগুলো ছড়িয়ে পড়ে সব ধর্ম-বর্ণ ও গ্রোত্রের মানুষের মধ্যে। জগজ্জননী মায়ের আগমনে এভাবেই হয়ে থাকে ‘সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব’।
শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে একে শারদীয় দুর্গোৎসব বলা হয়ে থাকে। শরৎকালটি এমনিতেই প্রকৃতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আরামের মৌসুম। বর্ষার প্রায় শেষদিকে এসময় মাঝে-মধ্যে থাকে আকাশে সাদা মেঘের ঘনঘটা। সেই সাদা মেঘের সাথে রঙ মিলিয়ে মাঠের কাছে বনের ধারে থাকে সাদা সাদা কাশ ফুল। বিকাল কিংবা রাতের প্রকৃতিতে শুরু হয় তখন আগমনী শীতের বার্তা। ঠিক এমন একটি মুহূর্তেই শুরু হয় শারদীয় সার্বজনীন দৃর্গোৎসব।
মহাসপ্তমীতে শুরু হয় মূল পূজা। ঢাকঢোলের তালে দেবীপূজার মূলপর্ব শুরু হয় এখান থেকেই। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঢাকের তালে নাচতে নেমে পড়ে সবাই। আর অষ্টমীর সকালে দেবী পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতে মহাসপ্তমীর রাতে নানা রকমের ফুল আর বেলপাতা সংগ্রহের কাজ করে কিশোর থেকে যুবক সবাই।
অষ্টমীর সকল বেলায় পরিবারের সবাই মিলে পূজাম-পে গিয়ে দেবীর পায়ে মন্ত্র পড়ে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া ছাড়াও কুমারী পূজা দেখতে ভিড় করেন। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া পূজার এ সময়টাতে আর তেমন বিশেষ কাজ থাকেনা কিশোর কিংবা যুবক বয়সীদের। চলাফেলা আর পড়াশুনায় বিধিনিষেধ না থাকায় যেন বেশি আনন্দেই মেতে উঠেন সবাই।
নবমী পূজার রাতের অনুভূতি থাকে বিসর্জনের বিষাদের বিচ্ছেদে আচ্ছন্ন। পূজা শেষের একটা বেদনা কাজ করে এ রাতে। তবে আরতি আর ঢাকঢোলের তালে সেটা খুব কমই বুঝা যায়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চারদিনের পূজা শেষে দশমীতে হয় মায়ের বিসর্জন।
কাজেই দেখা যাচ্ছে মানুষে মানুষে ধর্মে ধর্মে যতই ভেদাভেদ থাকুক না কেন সব ধর্মেরই মূল বাণী হলো আনন্দ, ত্যাগ, বিষাদ ইত্যাদির সমাহার। আর সবচেয়ে বেশি যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো সব ধর্মেরই আরেকটি অন্যতম মূল বাণী হলো মানব প্রেম ও মানব কল্যাণ এবং এ লক্ষ্যে সৃষ্টি গুণপূজারি করা। এবার করোনা মহামারির কারণে ঈদ অনুষ্ঠানসহ অন্য অনেক আচার অনুষ্ঠানাদি কাটছাট করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্ষিপ্ত কলেবরে পালিত হয়েছে। সেজন্য আগে থেকেই সরকারের তরফ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সর্বোচ্চ সতর্কতায় সর্বজনীন দুর্গোৎসব পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশাকরি মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে এবারে করোনাকালের শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভসূচনা হোক- এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম