Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

বগুড়া হানাদার মুক্ত দিবস বৃহস্পতিবার

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

বগুড়া হানাদার মুক্ত দিবস বৃহস্পতিবার

ঢাকা : বগুড়া মুক্ত দিবস ১৩ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এ দিনে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা শহরের ফুলবাড়ী ও পৌর পার্ক এলাকায় পাক বাহিনীকে পরাস্ত এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে বগুড়াকে হানাদার মুক্ত করে।

সেদিনের সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ’৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভোর থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়াকে শত্রু মুক্ত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এজন্য তারা শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে নওদাপাড়া, চাঁদপুর ও ঠেঙ্গামারা এলাকায় নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেন।

পরে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৬৪ মাউন্টেন্ট রেজিমেন্টের বিগ্রেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহের নেতৃত্বে ট্যাংক নিয়ে তাঁরা শহরের দিকে অগ্রসর হন। ওইসব এলাকার অসংখ্য যুবকও সেদিন তাঁদের সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর এইদিন বগুড়ায় তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা।

১৩ ডিসেম্বরের আগে ১০ ডিসেম্বর থেকে হানাদার বাহিনির সাথে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী কাধে কাধ মিলিয়ে মরণ কামড় দিয়েছিল। আকাশে মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান, মাটিতে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর অভিযানে দিশেহারা পাক হানাদার বাহিনীর কোনঠাসা হয়ে পড়ে।

নভেম্বরের শেষদিকে সারিয়াকান্দি থানা প্রথম হানাদার বাহিনী মুক্ত হওয়ার পর একে একে বগুড়ার সোনাতলা, গাবতলী, শিবগঞ্জ, ধনুট, শেরপুর। এরপর একসাথে ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া সদর, কাহালু, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া থানায় হানাদারদের পতন ঘটে। আদমদিঘী ১২ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়। তুমুল লড়াইয়ের পর ১৩ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত বগুড়া শহরে বারুদের গন্ধে বাতাস ভাড়ি হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক সূত্র থেকে ১৩ ডিসেম্বর বগুড়ার কয়েকটি জায়গায় পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

বগুড়ায় আব্দুস সবুর সওদাগর ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপুর নেতৃত্বে দুটি দল প্রায় একই সাথে বগুড়া শহরে প্রবেশ করে। সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপু জানান, আসলে ৮ ডিসেম্বর বিজয় এসেছে বগুড়ায়। কিন্তু অফিসিয়ালি ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া মুক্ত ঘোষণা হয়। তিনি আরও জানান, ২ ডিসেম্বর তারা সারিয়াকান্দি ও গাবতলী থেকে ১১ জন হানাদার বাহিনীকে আটক করে। এর মধ্যে ৫ জন মারা যায়।

৬ জনকে মিত্র বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। দল নিয়ে ঝড়ের গতিতে তারা বগুড়ায় এসে পৌছান ৮ ডিসেম্বর। ফুলবাড়ি এসে হানাদারদের সাথে তুমুল লড়াইয়ের পর তারা শহরের ভেতরে প্রবেশ করে আবার ফিরে যান ফুলবাড়ি কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা মরহুম মখলেসুর রহমানের বাড়িতে। ১৩ তারিখেই মিত্র বাহিনী বগুড়া শহর পুরো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর বিশিষ্ট প্রকৌশলী আওরঙ্গজেব এর নেতৃত্বে সারিয়াকান্দি থেকে পৌঁছায় শহরে।

জেলা সংসদের সাবেক কমান্ডার আমিনুল ইসলাম পিন্টু জানান, ১৩ অথবা ১৪ ডিসেম্বরই হবে বগুড়া হানাদার মুক্ত দিবস। এদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়া শহরে প্রবেশ করে। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা মাসুদার রহমান হেলাল বলেন, ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া মুক্ত হয়।

ঐ দিন মহাস্থানে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে পাক বাহিনীর অফিসারসহ বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়েছিল। পরে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা বাঘোপাড়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ১৪ ডিসেম্বর তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়া শহরে প্রবেশ করেন। পরে পরাজিত হানাদার পাক বাহিনীর সদস্যদেরকে বৃন্দাবন পাড়া ওয়াপদা এলাকায় কাঁটা তারের ঘেরায় ২/৩দিন রাখা হয়েছিল।

শহরে এ্যাডওয়ার্ড পার্কে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। সবুর সওদাগরের দলের মুক্তিযোদ্ধা সদস্য বদরুল আলম মুন্নু জানান, বগুড়া শহরে সকাল থেকে হানাদার বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী তীব্র আক্রমন শুরু করে। মাগরিবের নামাজের পর ফটকি ব্রীজের কাছে মিত্র বাহিনী তাদেরকে পাক হানাদার বাহিনীর নিহতদের লাশ ও আহতদের পৃথক করতে বলে। এর পর মিত্র বাহিনী তাদের স্থান ত্যাগ করতে বলেন।

তারা সেখান থেকে পাক বাহিনীর ১৩৭ জনকে আহত এবং ৩৭ জনের মৃত্যু দেহ পেয়েছেন। মুন্নু আরও জানান, ১৩ ডিসেম্বর বিকালে ঘোষণা দেওয়া হয় বগুড়া শহর হানাদার মুক্ত। ১৪ ডিসেম্বর সকালে তারা জনশূন্য শহর দেখতে পান।

সকলের মতে ১৯৭১ সালে ১০ ডিসেম্বর ভোরে মিত্র বাহিনী (ভারতীয় সেনা) এর ৬৪ মাউন্টেন রেজিমেন্টি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহ এক ব্রিগেড সৈয়ন নিয়ে বগুড়া শহরের ৩ কিলোমিটার উত্তরে নওদাপাড়া-চাঁদপুর ও ঠেঙ্গামাড়া গ্রামের মধ্যবর্তী স্থান লাঠিগাড়ি মাঠ সংলগ্ন বগুড়া রংপুর শহরে অবস্থান নেয়। আর্টিলারি ডিভিশন সেখানে বাঙ্কার খনন করে অবস্থান নেয়।

তারা বগুড়া শহরে পাক সৈন্যদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে শহরে অভিযান পরিচালনার জন্য ফ্রন্ট ফাইটার গোর্খা বাহিনীর সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহর অভিমুখে মার্চ করে। ১০, ১১ ও ১২ ডিসেম্বর তুমল যুদ্ধ হয়। ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে বলে সংবাদ পাওয়া গেলে বগুড়াবাসী সহ মিত্র বাহিনীর শিবিরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ১৩ ডিসেম্বর রাতের পর থেকে বুক ভরা শ্বাস ফেলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামি মানুষ। হানাদার বাহিনীর দোষর রাজাকার, আলবদর, আলসাম্স ও মুসলিম লিগের পান্ডারা ও বগুড়ার বিভিন্ন গ্রামে ও বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে।

এছাড়া ’৭১ সালের নভেম্বর মাসে শহরের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে বাবুরপুকুর নামক স্থানে ধরে নিয়ে গিয়ে ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী, সেইসব শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ। ফুলবাড়ীতে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের স্মরণে ২০০৫ সালে ‘মুক্তির ফুলবাড়ী’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।

শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ার। প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহাসিক নগরী মহাস্থানগড় খ্যাত বগুড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও অনেকটা স্থান জুড়ে রয়েছে। আগামী প্রজন্মকে সেই ইতিহাস সঠিকভাবে জানাতে প্রয়োজন একটি সমৃদ্ধশালী সংগ্রহশালা বা মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর প্রতিষ্ঠা। এমনটাই দাবি এ অঞ্চলের মানুষের।

 

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer