Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

কৃষকের বোরো ধানের মূল্য প্রাপ্তিতে কিছু পরামর্শ

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৬:৩৩, ১৮ মে ২০১৯

প্রিন্ট:

কৃষকের বোরো ধানের মূল্য প্রাপ্তিতে কিছু পরামর্শ

বাংলাদেশের ধান-চালের চাহিদার একটি বিরাট অংশ আসে বোরো মৌসুমে প্রাপ্ত ধান থেকে। কাজেই বোরো মৌসুমে কৃষকের কষ্টার্জিত এবং বহু মূল্যের বিনিময়ে উৎপাদিত ধানের মূল্য না পাওয়া এখন একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এবারেও (২০১৯) তার ব্যতিক্রম হলো না। অর্থনীতির সাধারণ একটি সূত্র হলো- কোন পণ্যের সরবরাহ যত বেশি হবে চাহিদা তত কমবে এবং মূল্যও তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমবে। যেকোন ফসলের ক্ষেত্রেই উৎপাদন মৌসুমে এমনটিই হতে দেখা যায়। তবে বাংলাদেশের প্রধান ফসল এবং প্রধান খাদ্য যেহেতু ধান সেজন্য উৎপাদন মৌসুমে এর মূল্যের একটি যৌক্তিক ভিত্তি থাকাট খুবই জরুরি।

বিশ্লেষণে দেখা যায় উৎপাদন মৌসুমে বোরো ধানের মূল্য কম থাকার কিছু কারণ বিদ্যমান রয়েছে। পুরো মৌসুমে কৃষক বোরো ধানের উৎপাদনের জন্য তার সারা বছরের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে ফেলে। অনেক কৃষকের সেই জমানো টাকাতেও খরচ মেটে না। সেজন্য তাকে মহাজন কিংবা দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে হয়। ফলে মৌসুম শেষে এসে কৃষক ঋণের ভারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় যেকোন মূল্যে ধান বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে নিয়ে ঋণ পরিশোধ করা কৃষকের একটি দায় হিসেবে দেখা দেয়। সেই সুযোগটাই ফড়িয়া, দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ে থাকে। তখন কৃষক কম মূল্যে তার উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

অন্যদিকে দেখা যায় সরকারি ক্রয় শুরু হয় একটু পরের দিকে অর্থাৎ তখন কৃষক তার সমস্যা যথারীতি তাদের আর্থিক ক্ষতি করেই কাটিয়ে উঠে। তাছাড়া সরকার সরাসরি ধান কৃষকের কাছ থেকে না কিনে স্থানীয় চাতাল ব্যবসায়ী বা মিল মালিকদের কাছ থেকে কিনে। সেজন্য মিল মালিকরাও সেই সুযোগে কৃষকের আর্থিক অনটনকে পূঁজি করে কম মূল্যে সেই ধান কৃষকের কাছ থেকে আগে-ভাগেই কিনে নেয়। আর সরকার শুকনো ধান কিনে থাকে। অর্থাৎ গুদামজাত করতে হলে যেভাবে শুকিয়ে ধান বিক্রি করতে হয় সেখানে কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না। কাজেই সদ্য সংগৃহীত কাঁচা ধান সরাসরি মাঠ থেকেই তা কমদামে বিক্রি করে দিচ্ছে কৃষকরা।

উৎপাদন মৌসুমে দেশের সবস্থানেই প্রায় একই সময়ে ধানকাটা শুরু হয়। তাই ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যা-ও পাওয়া যায় তার জন্য আবার অধিক মূল্য পরিশোধ করতে হয়। সেজন্য জমির ভাড়া, সার ও শ্রমের মূল্য, সেচ ও আবাদ বাবদ খরচ মিলে মণপ্রতি ধান উৎপাদনে যে খরচ হয় (৭০০ থেকে ৮০০ টাকা) তাৎক্ষণিক বিক্রি করলে (৫০০ থেকে ৬০০ টাকা) তাতে কৃষকের লোকসান গুণতে (মণপ্রতি প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা) হয় সত্য। কিন্তু সেই ধানই যদি আবার নির্ধারিতভাবে শুকিয়ে এবং কিছুদিন (মাত্র ১ থেকে ২ মাস পর) সংরক্ষণ করার পর বিক্রি করা যায় তাহলে এর সঠিক ও লাভজনক মূল্যটা কৃষক পেতে পারে।

বর্তমানে যে পরিমাণ ধান অর্থাৎ ১২ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন মাত্র সরকারিভাবে ক্রয় করা হয় যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এর কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে দেশে বর্তমানে এর থেকে বেশি ধান-চাল সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় গুদাম বা সাইলো নেই। কিন্তু আমরা জানি এখন সরকারের আর্থিক সক্ষমতা অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে অগ্রসরমান। কাজেই দেশের স্বার্থে এবং দেশের কৃষকের স্বার্থে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে। সেজন্য সারা দেশে সংরক্ষণাগার প্রয়োজনীয় সংখ্যক বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া বর্তমানে সরাসরি মিল মালিকদের কাছ থেকে ক্রয় করে থাকে সেখানে আগামীতে তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনতে হবে। সেখানে একেবারে মৌসুমে অবশ্যই কৃষকের ক্ষেত থেকে কাঁচা ধান কেনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কাঁচা ধানের জন্যও একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে।

এবছর (২০১৯) সরকারিভাবে শুকনো ধান ২৬ টাকা কেজিতে এবং সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা কেজি এবং আতপ চাল ৩৫ টাকা কেজি দরে কেনা হচ্ছে। সরকারিভাবে ক্রয়ের জন্য দামের ব্যাপারে অবশ্য কারোর তেমন কোন আপত্তির কথা শোনা যায়নি। শুধু অপত্তি হলো পরিমাণ, সময় ও পদ্ধতির উপর। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের তরফ থেকে এ সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। সেখানে যেকোন মুহূর্তে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সেজন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখতে হয়। আর যেবছর তা হয়না তখন তা গুদামেই নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য চাল বিদেশে রপ্তানির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

তবে যাই হোক না কেন এসব চিন্তা-ভাবনা বা পরিকল্পনা করতে হবে মৌসুম শুরু হওয়ার একটি যৌক্তিক সময় পূর্বেই। কারণ বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষকরতœ শেখ হাসিনার একটি অন্যতম শ্লোগান হলো- ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। কাজেই এর মর্মার্থ উপলব্ধি করেই সকলকে কাজ করতে হবে। অন্যথায় কৃষক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতেই থাকবে। বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে আরেকটু এগিয়ে আসা দরকার। এমনিতেই তারা কৃষকের কল্যাণে অনেক কিছু করে যাচ্ছেন সত্য। যেমন মাত্র দশ টাকা দিয়ে কৃষককে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দিয়েছে সরকার। অপরদিকে কৃষকের উৎপাদনের জন্য সার, বীজ, সেচসহ সকল প্রকার কৃষিখাত ও উপকরণে সরকার ভর্তুকি এবং প্রণোদনা দিয়ে থাকে। সেখানে উৎপাদন খরচ অনেকংাশে কমে আসে।

এতকিছু যেহেতু কৃষকের ভালোর জন্যই করা হচ্ছে, সেজন্য আরো কিছু কাজ অবশ্যই করা প্রয়োজন। বোরো ধানের সঠিক মূল্য পাওয়ার জন্য সরকারি ক্রয়, বিদেশে রপ্তানি, গুদাম বা সাইলো তৈরী করতে হবে- সেগুলো একটু সময় সাপেক্ষ। কিন্তু কৃষকের মূল্য পাওয়ার বিষয়টি এক্ষুণি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর তা এ মৌসুমে হয়তো করা সম্ভব হবে না। তাই আগামী বছরে (২০২০) করার জন্য তা এখন থেকেই নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটি নিশ্চিত করার জন্য ধান কাটার মৌমুমে যাতে পানির দামে কৃষককে ধান বিক্রি করতে না হয় এবং তা যেন কমপক্ষে ২-৩ মাস রেখে পরে বিক্রি করতে পারে সেজন্য তাকে স্বল্পসুদে, বিনাশর্তে, অল্প পরিমাণে, স্বল্পমেয়াদি কৃষি ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে জমির মালিকের পাশাপাশি বর্গা চাষীকেও সমানভাবে বিবেচনা করতে হবে।

যদি কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা হয় কিংবা কৃষককে আপদকালীন সময়ের জন্য বিশেষ কৃষি ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় তবে তা আগে-ভাগেই কৃষকের মাঝে প্রচার করতে হবে, যাতে এর সুযোগ আর কেউই নিতে না পারে। এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সারা দেশে একটি সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করে থাকি কৃষকের কোন সংগঠন নেই, তাই কৃষকের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। সেজন্য দেখা গেছে টাঙ্গাইলের একজন কৃষক শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে না পেয়ে এবং উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার আশঙ্কায় তার ধানক্ষেতে নিজেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেটি দেখে সারা দেশজুড়ে কৃষকের সন্তান পরিচয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির জন্য মানববন্ধন করেছে। কাজেই বিষয়টি এখন আগের তুলনায় অনেক গণমুখী হওয়ায় সে বিষয়ে কার্যকর সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রত্যাশিত।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer