ছবি: বহুমাত্রিক.কম
সুনামগঞ্জ : জল আর জলের গন্ধ আজন্ম সুনামগঞ্জের হাওরবাসীর জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। জীবনের প্রতিটি মুর্হুতে মিশে থাকে জল। সেই জলেই তাদের জীবনে এবার তাদের চোখের জলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলেই একাকার হয়েছে হাওর পাড়ের হাজার হাজার কৃষকের বোরো ধানের জমির ফসল। এই জলে তলিয়েছে তাদের বসতিও।
অকাল বন্যায় একমাত্র বোরো ধান হারিয়ে হাওর জুড়েই হাহাকার। দু’মুঠো খাবার যোগাড় করে জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের করতে হচ্ছে নিরন্তর সংগ্রাম। এই দুঃসময়ে খুশির ঈদ হাওরবাসীর কান্নার ঈদ আনন্দ হয়ে হাজির হয়েছে।
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অনেক পরিবার তাদের ছেলে-মেয়েদের নতুন কাপড় কিনে দিতে পারে নি। অভাবের তাড়নায় নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদাও মিটাতে পারে নি। সংগ্রামী হাওরবাসী সকল কষ্ট ভুলে সম্মিলিত ভাবেই হাওর পাড়েই ঈদুল ফিতরের নামাজের জামাত পড়েছে। নামাজ শেষে একে অন্যের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করা চেষ্টা করছে।
হাজারো কৃষক পরিবার কষ্ট ভুলে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে চেষ্টা করলেও জীবন বাঁচার একমাত্র বোরো ধান হারিয়ে মনের ভিতরে রয়েছে চাপাকষ্ট। হাওর মানে মাছ কিন্তু হাওরে এবার নেই সেই মাছ। বোরো ধান হারানোর পর মাছে মড়ক দেখা দেওয়ায় এই সময়ে জীবিকা নির্বাহের বিকল্প সুযোগটিও হারায় হাওরবাসী। ফলে আরও দুর্বিষহ হয়েছে তাদেও বেঁচে থাকার চেষ্টা।
হাওর মানেই ভাটিয়ালী গান ডোল, নৌকার ঢেউয়ের তালে একতার সুরের সম্মিলন। এসবের মাঝেই লুকিয়ে আছে হাওরবাসীর সুখ-দুখ। হাওর মানেই নানা প্রতিকুলতায় জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা। হাওরপাড়েই জন্মেছেন হাছন রাজা, রাধারমন, শাহ আব্দুল করিমের মতো সঙ্গীতের দিকপালরা। তাদের মরমী সঙ্গীত পাল্টে দিয়েছে হাওরবাসীর জীবনবোধকে।
এই ঈদে এবার নেই হাওরপাড়ে তাদের কালজয়ী গানগুলো মাইক কিংবা স্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠে শুনে ঈদ উদযাপন করার আয়োজন। সব কিছুতেই নীরবতা বিরাজ করছে। হাওর পাড়ে দেখা যায় নি তেমন কোন উৎসাহ উদ্দীপনা। এবার জেলার দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, দোয়ারা বাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার হাওরগুলোতে স্মরণকালের ভয়াবহ এই অকাল বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক পরিবার গুলো।
এদিকে সরকারি ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি, টিসিবির পণ্য বন্ধ, ভিজিএফ কার্ডে অনিয়ম ও ওএমএস চাল সঠিক ভাবে পায় নি হাওরবাসী। এ অবস্থায় নিজের ও পরিবারের জন্য দু-মুঠো খাবার জোগাড় করা দায় হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ হাওরবাসী অর্ধহারে, অনাহারে, অভাব-অনটন কে সঙ্গী করে খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে জীবন পার করছে।
জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অকালে এক ফসলি বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা ও উপজেলার বাজার সহ প্রতিটি বাজারেই চালের দোকানগুলোতে চাল নেই। অনেকেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বেশি নিয়ে বিক্রি করছে দোকানীরা। হাওর ডুবে যাওয়ার পর থেকে সরকারী সহযোগীতা পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপসদৃশ্য গ্রামগুলোতে টাকার অভাবে অনেকেই বাজার-সদাই করতেও পারছেন না। ফসলহারা মানুষ গুলোর এখন দিন কাটে ভিজিএফ কার্ড ও খোলা বাজারে কম মূল্যের চালের আশায়। দূর-দূরান্ত থেকে চাল নিতে আসা মানুষজন সকাল থেকে সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে ডিলারদের কাছ থেকে পাচ্ছে না।
তাহিরপুরের সাদেক আলী বলেন, কি কইমু ভাই এবার বোরো ধান হারিয়ে এক বারেই নিঃস্ব হয়ে গেছি। হাতে টাকা না থাকায় পোলা মাইয়ারে নতুন কাপড় কিনা দিতা পারি নাই আর জীবন কেমনে চালাইমু বুজতা পারতাছিনা।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কারুজ্জামান কামরুল বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগোপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে অবহেলিত সুনামগঞ্জ জেলার হাওরবাসীর উন্নয়ন সম্ভব।
বহুমাত্রিক.কম