
ফাইল ছবি
শেষ পর্যন্ত সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা কিছুটা খর্ব হলো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে। চলতি অর্থবছরে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দেয়ার বিষয়টি ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অথচ সাধারণ নাগরিকদের গাড়ি আমদানিতে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক ও ভ্যাট দিতে হয়।
১৯৮৮ সালের ২৪ মে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে তৎকালীন সরকার সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক ও কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, এ সুবিধায় ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত গত ১৫ বছরে সংসদ সদস্যরা মোট ৫৭২টি গাড়ি আমদানি করেছেন। এসব গাড়ির মূল্য ছিল প্রায় ৩৯৭ কোটি টাকা। শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা নিয়ে ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা শুল্ক মওকুফ পেয়েছেন তারা।
এনবিআর সূত্র আরও জানায়, এই ৫৭২টি গাড়ির মধ্যে অন্তত ৫৬৩টি জাপান থেকে আনা হয়েছে। গাড়ি আনা হয়েছে অন্যান্য দেশ থেকেও; যার অধিকাংশই বিলাসবহুল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, রেঞ্জ রোভার ও মিতসুবিশি পাজেরোসহ অন্যান্য ব্রান্ড। অথচ সাধারণ নাগরিকদের এসব গাড়ি আমদানি করতে ১০০ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক দিতে হয়। এর বাইরে গাড়ির ইঞ্জিন ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে দিতে হয় নানাবিধ সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট।
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়ি সংসদ সদস্যদের নিজেদের ব্যবহারের কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এসব গাড়ি পরবর্তীতে বিক্রি করে দেন তারা। যদিও আইন অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির তিন বছরের মধ্যে সেটি বিক্রি করার অনুমতি নেই। এই সুবিধার অপব্যবহারের প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিধানটি বাতিল করা হয়। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সেটি আবার চালু করে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট মেটাতে সরকারকে দেয়া ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে চাপ দেয় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আইএমএফ। এর অংশ হিসেবে নতুন করক্ষেত্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রথমবারের মতো এমপিদের গাড়ি আমদানির ওপর শুল্ক বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
এ ব্যাপারে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা তাদের গাড়ি কেনার ওপর শুল্ক অব্যাহতি পাবেন। এটা তারা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য প্রণয়ন করেছেন। যেখানে তারা দেশের সাধারণ মানুষের ওপর কর বসান, সেখানে তারা যদি নিজেরাই শুল্ক না দেন, তবে সেটা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত তা তারাই বিবেচনা করবেন। যিনি নিজে কর আরোপ করছেন, সেখানে তিনি নিজে কতখানি সুবিধা নিচ্ছেন সেটা তাকেই বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি নিজের এলাকার ভোটারদের সামনেও তারা এ ব্যাপারে কিভাবে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন, সেটা তারোই ভালো বলতে পারবেন।’
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ মামুন রশীদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজের উদ্যোগে এই শুল্ক আরোপ করেছেন। এতদিন তাদের কোন শুল্ক দিতে হতো না। একই গাড়ির জন্য যেখানে সাধারণ নাগরিকরা শুল্ক দিচ্ছেন ৫০০ শতাংশ, সেখানে আগে একজন এমপিকে কোন টাকাই দিতে হতো না। এটা কতটুকু বিবেচনা প্রসূত সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, তারপরও প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে অন্তত তাদের শুল্ক দেয়ার বিষয়টি শুরু হলো। এটাকে স্বাগত জানানো উচিত।
তিনি বলেন, এবার আইএমএফ-এর চাপে বাজেট প্রণয়নের সময় দেখা হয়েছে নতুন কোন জায়গা থেকে কর ও শুল্ক আহরণ করা যাবে। সেক্ষেত্রে শুল্ক ও কর আহরণের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে এমপিদের গাড়ি আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ২৫ শতাংশ দিয়ে শুরু করার কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বাজেট পরামর্শক কমিটির সবশেষ বৈঠকে বলেছিলেন এটা শুরু করার কথা। সে হিসেবে এটাকে স্বাগত জানানো উচিত। তবে এমপিদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেয়ার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই চলে আসছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর অব্যাহতির রাজনীতি একটা গভীরের রাজনীতি।
এমপিদের গাড়ি আমদানির ওপর প্রথমবারের মতো এ ধরনের শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ এর গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বলেন, রাষ্ট্রপতির এক আদেশের মাধ্যমে সংসদ সদস্যরা এই সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। তবে পরবর্তীতে এর প্রয়োজন আছে কি না সে বিষয়টি বিবেচনা করে এ ব্যাপারে পরবর্তী রাষ্ট্রপতিদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হতো, এই বিধান থাকা না থাকার ব্যাপারে। আর যে সময়ের বিবেচনায় এমপিদের এই সুবিধা দেয়া হতো তা তৎকালীন প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক ছিল। কারণ সে সময় অনেক এমপিই অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল ছিলেন। তাদের গাড়ি কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাদের যেন সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে অসুবিধা না হয়, পাশাপাশি তারা যেন তারা নিজেদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক রাখতে পারেন, সে বিবেচনাতেই এমপিদের শুল্ক ছাড়াই গাড়ি কেনার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ বর্তমানের অধিকাংশ এমপিই বিত্তশালী এবং ব্যবসায়ী ঘরানা থেকে এসেছেন। তাদের জন্য এ ধরনের সুযোগ সুবিধা বহাল রাখার প্রয়োজন আছে কিনা তা ভেবে দেখার বিষয় নীতিনির্ধারকদের। কারণ একজন সাধারণ নাগরিক একই গাড়ি কিনবেন ৫০০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে, সেখানে সংসদ সদস্যদের তেমন কিছুই দিতে হবে না, এ ধরনের শুল্ক সুবিধার বিষয়টিকে সামঞ্জস্যের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এটা যে এ বছর প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে শুরু হলো, সেটাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হবে।