
ছবি: বহুমাত্রিক.কম
গ্রামবাংলার ঈদ মানেই আনন্দ, উৎসব এবং পারিবারিক মিলনমেলা। পরিবারের সকলে একত্রিত হয়ে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে গ্রামগঞ্জে গ্রামীণ প্রকৃতির ছায়াতলে উদযাপিত হয় মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব। তবে গ্রাম এখন আর নেই আগের মতো ঈদের আনন্দ।
এক-দেড় দশক আগেও ঈদের অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকেই গ্রামজুড়ে ঈদের প্রস্তুতি শুরু হতো। শিশু থেকে মুরুব্বি সবাই ঈদের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠত। নারীরা ব্যস্ত থাকত নানা ধরনের পিঠা তৈরির আয়োজনে। ঈদকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হতো নানা ধরনের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট বদলে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার, নগরায়ণের প্রভাব, সামাজিক পরিবর্তন, রাজনৈতিক বিভাজন ও নানা সামাজিক ব্যাধির কারণে গ্রামগঞ্জের ঈদ উচ্ছ্বাস অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি ভাওয়াল জনপদের (বর্তমান গাজীপুর জেলার) এক নিভৃতগ্রাম নয়াপাড়া। সবুজ শ্যামলে ঘেরা এই নিভৃতপল্লীতে একসময় ঈদ এলেই এক অন্যরকম উৎসবের রেশ ছড়িয়ে পড়ত। গতকয়েক বছর আগে কোরবানির ঈদকে ঘিরে বাড়ি বাড়ি যে আমেজ বিরাজ করত এবছর তার ছিটে ফোঁটাও নেই। কোরবানির পশু নিয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আগে ছিল এখন তা খুব একটা নেই, অধিকাংশই মোবাইল গেমিংয়ে আসক্ত।
পেশাগত প্রয়োজনে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পরিবার নিয়ে শহরে বসবাস করেন। ঈদের ছুটি শুরু হলেই তারা স্ত্রী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে আসতেন গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে। কিন্তু এখন বদলে গেছে সেই চিত্র, অনেকের বাবা-মা জীবিত নেই, তাই আর ফেরা হয় না গ্রামের পথে। আবার কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে গিয়ে ঘর বেঁধেছে, সেখানেই উদযাপন করেন ঈদ। ফলে পরিবার-পরিজন একসঙ্গে না হওয়ায় গ্রামে ঈদের আনন্দ কিছুটা কমে গেছে।
আগে রমজানের ঈদের আগের রাতে সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ দেখা গেলে গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়েরা আনন্দে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠত। তারা দল বেঁধে পাড়া-মহল্লায় আনন্দ মিছিল করত, মুখে মুখে ধ্বনিত হতো "চাঁদ উঠেছে রে, ওই চাঁদ উঠেছে " একই সময়ে প্রতিটি ঘরে টেলিভিশনে বাজতে থাকত নজরুলের সেই কালজয়ী গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। সেই সময়ের আনন্দ একে অপরের মুখে হাসি এবং ঈদের চাঁদকে ঘিরে শিশু কিশোরদের মাঝে যে উচ্ছ্বাস ছিল কালের বিবর্তনে তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
ঈদের আগের রাতে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ছোট সদস্যরা মেহেদির বাক্স হাতে দৌড়ে বড় বোনের কাছে যেত। লম্বা সিরিয়াল থাকলেও কেউ বিরক্ত হতো না বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করত, কখন ছোট্ট হাত রঙিন হয়ে উঠবে লাল রঙে। ঈদের দিন সকালে প্রথম কাজই ছিল সবাই একত্রিত হয়ে দেখা, কার হাতের মেহেদির রং সবচেয়ে গাঢ় হয়েছে, সেটা নিয়ে চলত হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ, বিচার-বিশ্লেষণ।
এক দশক আগে ঈদকে ঘিরে বাড়ি বাড়ি বসত পিঠা তৈরির মহল। কয়েক বাড়ির নারী সদস্যরা একত্রিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে জড়ো হতেন এবং চালের গুঁড়া পানি দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে হাতে তৈরি করতেন এক ধরনের সেমাই, যা "হাতের সেমাই" নামে পরিচিত। এছাড়া চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হতো সিরিঞ্জ পিঠা। এটি বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে ফুল আকৃতির , ত্রিভুজ এবং চতুর্ভুজের মতো করেও বানানো হতো । এছাড়াও চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হতো নানা ধরনের পিঠা যেমন ফুল পিঠা, পাতা পিঠা , নিমকি পিঠা ইত্যাদি। সময়ের পরিবর্তনে সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রামীণ ঐতিহ্য আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
একসময় এই গ্রামের সকল ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে শ্রীপুরের কাশেমপুর বাজার ঈদগাহ মাঠে ছুটে আসতেন, যেখানে পুরো গ্রামের মানুষ একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। বছর পাঁচেক আগেও এমন দৃশ্য দেখা যেত। এখন পাড়া-মহল্লায় নতুন নতুন মসজিদ গড়ে ওঠায় সেখানেই ছোট পরিসরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঈদের জামাত। এর ফলে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও পরম্পরা ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে।
দুই দশক আগেও এই জনপদে বিদ্যুৎ ছিল না, স্মার্টফোন ছিল প্রতিটি মানুষের কাছে স্বপ্নের মত। সময়ের পরিবর্তনে আধুনিক হয়েছে দেশ, তেমনি আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামগঞ্জেও। প্রযুক্তির এই সুবিধার ফলে তরুণ প্রজন্মের হাতে হাতে পৌঁছেছে স্মার্টফোন । স্মার্টফোন হাতে পেয়েই তারা ভুলে গেছে তাদের ঐতিহ্য-পরম্পরা। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ তরুণই বিভিন্ন ধরনের মোবাইল গেমে আসক্ত , যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গ্রামাঞ্চলের একটি মারাত্মক ব্যাধি হলো মাদক। এবছর পবিত্র রমজান মাসেও গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অবাধে চলছে মাদকের বেচাকেনা। রমজানে দেখা গেছে সারাদিন রোজা রেখে ইফতার শেষেই এক শ্রেণির তরুণ মাদকের জগতে ডুব দেয়। পবিত্র ঈদুল আযহার আগের রাতের দৃশ্য আরও ভয়াবহ সাউন্ডবক্স বাজিয়ে মদ, গাঁজা, ইয়াবা সেবন করে ঈদ উদযাপন করে এই প্রজন্মের অনেক তরুণ। কিন্তু এ অবস্থার পরও অভিভাবক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো কার্যকর তৎপরতা দেখা যায় না।
একসময় ঈদ এলেই গ্রামাবাংলায় নানা ধরনের মেলা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো যা ঈদ আনন্দকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিত। তবে বর্তমানে এইসব আয়োজন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ধরনের আয়োজন না হাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম মোবাইল , সোশ্যাল মিডিয়া এবং গেমের প্রতি আরও বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে।
সাবিত হাসান শাওন বলেন, ঈদে এখন আর আগের মতো আনন্দ হয় না; নামাজের পরেই যেন ঈদ আনন্দ শেষ । আগে একসঙ্গে অনেক মানুষ ঈদের নামাজ আদায় করতাম, সবাই এক জায়গায় নামাজ আদায় করলে ঈদ আনন্দ আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। এখন ঈদ শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আগের দিনের মতো ঈদের আমেজ এখন আর দেখা যায় না ,যা খুবই দুঃখজনক।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে সেগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে যেন তারা এগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতেও টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী হয়।