Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ২০ ১৪৩২, রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫

জয়দেবপুর: স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ

মোঃ মুজিবুর রহমান

প্রকাশিত: ০১:০৮, ১৯ মার্চ ২০১৯

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

জয়দেবপুর: স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ

ছবি- সংগৃহীত

সাল ১৯৭১। মার্চ মাস। অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল স্রোত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল স্রোতে বাঙালি জাতি নিজেকে সম্পৃক্ত করে। এ রকম সম্পৃক্ত করার মতো একটি দিন হলো ১৯ মার্চ ১৯৭১। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে আমাদের চূড়ান্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও এর সাতদিন আগেই বীর প্রসবিনী জয়দেবপুরের (বর্তমান গাজীপুর) মাটিতে শুরু হয় সংগ্রামী শ্রমিক-ছাত্র-জনতার প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ, যা বাংলাদেশের ২৩ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলন- সংগ্রামের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। কেননা ১৯শে মার্চ জয়দেবপুরের মাটিতে সূচিত হয়েছিল বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ।

এ দিনই দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল মুক্তিপাগল বাঙালির তরফ থেকে প্রথম আগ্নেয়াস্ত্র। সেদিন জয়দেবপুরের শ্রমিক-ছাত্র-জনতার অতুলনীয় বীরত্বব্যাঞ্জক ও সাহসী ভূমিকা সমগ্র বাংলাদেশে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল এবং পুরো জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর একচিঠিতে যা লিখেছিলেন ১৯৭১ সালের প্রতিরোধ যুদ্ধ সম্পর্কে তার কিছু অংশ তুলে ধরলাম ‘আমি (বঙ্গবন্ধু) তার (১৯ মার্চ ১৯৭১) কয়েকদিন মাত্র পূর্বে ৭ই মার্চ তারিখে ডাক দিয়েছিলাম যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোল। জয়দেবপুরবাসীরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আমি তাদেরকে মোবারকবাদ জানাই।’

ঢাকার ৩০ কিলোমিটার উত্তরে জয়দেবপুর বর্তমানে গাজীপুর জেলা। গাজীপুর তৎকালীন সময়ে ঢাকা জেলার একটি মহকুমা ছিল ঢাকা উত্তর মহকুমা। পরিচিত ছিল জয়দেবপুর নামে। ঢাকার নিকটবর্তী জয়দেবপুরে ভাওয়ালের ঐতিহাসিক রাজবাড়ীতে ছিল ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদর দপ্তর। এ রেজিমেন্টে ২৫/৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি সৈন্য।

মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এর অংশ হিসেবে কৌশলে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। বিষয়টি ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু বাঙালি অফিসার-সৈনিক বুঝতে বা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তারা এ আশংকার কথা গোপনে জয়দেবপুরের সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেন।

জয়দেবপুরের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাহসী ভূমিকার কারণে সেদিন জয়দেবপুরের সর্বস্তরের জনতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। এই সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন নিয়ামত, মনু খলিফা ও হুরমত। এই ধরনের প্রতিরোধ যুদ্ধ চলমান অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে যোগ করে নতুন মাত্রা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্য ও বাঙালির মধ্যে বিছিন্ন-বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও এদিনই প্রথম শুরু হয় সংগ্রামী জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ, যা বাঙালিকে সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল।

বিবিসিসহ সকল আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জয়দেবপুরের শ্রমিক-ছাত্র-জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের সংবাদ প্রচার করে। পরের দিন বাংলাদেশের সকল সংবাদপত্রে এই সশস্ত্র যুদ্ধের সংবাদ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। সারাদেশে শে¬াগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ এর আগে উলে¬খ করেছি, আবার উল্লেখ করছি ১৯ মার্চ ১৯৭১ বাঙালির ২৩ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলন- সংগ্রামের একটি অবিস্মরণীয় দিন।

একাত্তরের ১ মার্চ দুপুর ১টায় বাঙালি জাতি রেডিও মারফত জানতে পারে যে, ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসার কথা, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার পরপরই মুক্তিপাগল বাঙালি রাজপথে নেমে আসে। এদিকে তখন জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার হোটেল পূর্বাণীর হল রুমে আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। হাজার হাজার মানুষ তখন হোটেল পূর্বাণীর সমনে সমবেত হয়ে প্রতিবাদ ও শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করতে থাকেন।

এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত।’ এরপর বঙ্গবন্ধু হোটেলের লাউঞ্জে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচী হিসেবে ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা হরতাল ঘোষণা করেন এবং ৭ মার্চ ভাষণ দেবেন বলে জানান। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন।

সেই দুর্বার আন্দোলনের তীব্রতায় সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে উঠল অগ্নিগর্ভ। সেই আন্দোলনের ঢেউ জয়দেবপুরে লাগলো প্রবলভাবেই। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে সেই আলোচনা চলতে থাকে জয়দেবপুরের সর্বত্রই। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও সরাসরি এই অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। প্রতিদিন জয়দেবপুরে প্রতিবাদ সভা করে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন। এতে জয়দেবপুরের শ্রমিক-ছাত্র-জনতার একতা আরও দৃঢ়তর হতে থাকে।

একাত্তরের ২ মার্চ রাতে তৎকালীন থানা পশুপালন কর্মকর্তা আহমদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসায় তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ হাবিব উল্লাহ এক সর্বদলীয় সভা আহবান করেন। ওই সভায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, তার দু’টি শাখা ছিল। একটি হলো ‘হাইকমান্ড’ অপরটি ‘এ্যাকশন কমিটি’। হাইকমান্ডে অন্তর্ভুক্ত নেতাদের মধ্যে ছিলেন মোঃ হাবিবুল্লাহ, ডা. মনীন্দ্রনাথ গোস্বামী, এম. এ. মোত্তালিব। এ্যাকশন কমিটিতে ছিলেন আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক-আহ্বায়ক (বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী) ও নজরুল ইসলাম খান-কোষাধ্যক্ষ, মোঃ নূরুল ইসলাম (সদস্য) মোঃ শহীদুল্লাহ বাচ্চু (সদস্য), মো: হারুন অর রশিদ ভূঞা (সদস্য), আবদুস সাত্তার মিয়া (সদস্য), শহীদুল ইসলাম পাঠান (সদস্য), অধ্যাপক মোঃ আয়েশ উদ্দিন (সদস্য) , ডা. সাঈদ বক্স ভুঁইয়া (সদস্য), অ্যাড. মোঃ হযরত আলী ( সদস্য) ও শেখ আবুল হোসাইন (সদস্য)। সে সময় যেসব নেতা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন ও অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করেন, তাঁরা হলেন আবদুল বারিক মিয়া, অধ্যাপক মোঃ শহীদুল্ল্যাহ, অধ্যাপক ইয়াকুব আলী সরকার, কাজী আলিমউদ্দিন বুদ্দিন, মোঃ হাবিবুর রহমান, জামাল হায়দার, আহসানুল হক ভুঁঞা কাকুল প্রমূখ।

জয়দেবপুর এলাকার বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধরু ভাষণ শোনার জন্য রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সেই ভাষণ শোনার পর সন্ধ্যায় জয়দেবপুর ফিরেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বৈঠকে বসলেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বেই সব ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মসূচি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৭ মার্চের পর থেকেই জয়দেবপুরে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন, শুরু হয় সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল। পাশাপাশি জয়দেবপুরে সৃষ্টি হলো আন্দোলনের নতুন গতি।

ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) সে সময় অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। প্রথমদিকে এই রেজিমেন্টের বাঙালি অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদুল হোসেন খান আর সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর সফিউল¬াহ (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার, এস ফোর্সের অধিনায়ক এবং পরে স্বাধীনতা-উত্তর সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন)। ১৯ মার্চের ঘটনার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদকে অপসারিত এবং ২৫ মার্চ লে. কর্নেল রকিবকে অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।

এই রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সব বাঙালি অফিসার ও সৈনিক মনেপ্রাণে ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোয় বাঙালিদের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করার জন্য যে নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী, তার মধ্যে ছিল বিভিন্ন সেনা ছাউনিতে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের কৌশলে নিরস্ত্র করা। এই অপকৌশলের অংশ হিসেবেই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্ত্রগুলো ১৫ মার্চ সদর দপ্তরে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল এক লেখনীতে উল্লেখ করেন, “মনে পড়ে , সেদিন ছিল ১৭ মার্চ বুধবার, মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নেমেছিল ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। তৎকালীন আমাদের নির্বাচনী এলাকার এম. এন. এ শামসুল হক (পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্য), হাবিব উল্লাহসহ আমি গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকে জয়দেবপুরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার সংবাদ দিতে। শামসুল হক সাহেবের ইশারায় আমি তরুণ হিসেবে এ অবস্থায় আমাদের কী করণীয় জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু ব্যাঘ্রের ন্যায় গর্জে উঠে বললেন, “তুই একটা আহাম্মক, কী শিখেছিস যে আমাকে বলে দিতে হবে।” একটু পায়চারী করে বললেন“ বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা যাবে না।”

এদিকে এই রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্র জমা দেওয়ার বদলে কৌশলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। বাঙালি সৈন্যদের এই মনোভাব টের পেয়ে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ১৯ মার্চ এক কোম্পানি সৈন্যসহ নিজে এসে উপস্থিত হন ভাওয়াল রাজবাড়ীতে। এ খবর জয়দেবপুরে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। বাঙালি সৈন্যদের পক্ষে হাজার হাজার শ্রমিক ছাত্র ও জনতা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা ছাউনির (ভাওয়াল রাজবাড়ী) চারপাশে গড়ে তোলে প্রতিরোধ ব্যূহ। সেদিন ছিল শুক্রবার। জয়দেবপুর ছিল হাটের দিন। শুক্রবার হাটের দিন আর জুম্মার নামাজ আদায় করে হাজার হাজার জনতা ইট পাটকেল নিয়ে সমবেত হতে থাকে। সমরাস্ত্র কারখানা ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির বিপুলসংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ ফেলে চলে আসেন জয়দেবপুরের বাজারে প্রতিরোধ গড়তে। জয়দেবপুর রেল ক্রসিং-এর মালগাড়ির একটা ওয়াগন এনে রাস্তা অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। মিছিল-শ্লোগানে জনতা জঙ্গিরূপ ধারণ করে।

এ খবর শুনে ক্ষুব্ধ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব রাস্তা পরিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন রেজিমেন্ট কমান্ডার লে. কর্নেল মাসুদকে। লে. কর্নেল মাসুদ মনেপ্রাণে স্বাধীনতার আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। তাই তিনি এই ব্যারিকেড অপসারণে গ্রহণ করলেন নমনীয় কৌশলে। তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দ মোঃ হাবিবুল্লাহ , আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, এম. এ. মোত্তালিব-কে ডেকে রাস্তা পরিষ্কার করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু নেতৃবৃন্দ এতে সম্মত না হলে আরো ক্ষুদ্ধ হয়ে জাহানজেব প্রয়োজনে গুলি করে রাস্তা পরিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের অগ্রনায়ক আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক বলেন, “সেদিন বিকেল ৪টার দিকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ হাবিবুল্লাহ , আমি ও শ্রমিক নেতা এম. এ. মোত্তালিব জাহানজেবের সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি আমাদেরকে বললেন জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সরিয়ে দিতে হবে। তখন আমরা বললাম, আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে যে, আপনারা বাঙালি সৈন্যদেরকে ডিজার্ম (নিরস্ত্র) করতে এসেছেন, এটা হতে পারে না। তখন সে বললো, না আমরা রুটিন ইনসপেকশন করছি। আমরা চলে যাবো। সে সময় তাকে বোঝা যাচ্ছিল যে সে শঙ্কিত। এদিকে সে বাঙালি অফিসারদের সাক্ষী মানে। বাঙালি অফিসাররাও বললো, হ্যাঁ তারা রুটিন ইনসপেকশনে এসেছেন। চলে যাচ্ছেন, কোনো ডিজার্ম করছে না। তখন আমরা বললাম ঠিক আছে এই কথা আমাদেরকে আন্দোলনরত ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে বলতে হবে। তাদেরকে কনভিনস করে তারপর ব্যারিকেড সরাবো। এভাবে ব্যারিকেড সরানো যাবে না। আমরা বললাম আপনারা ব্যাক করে রাজবাড়িতে যান, আমরা আন্দোলনরত কর্মীদের বোঝাই। আমাদের কথা শুনলো না। এভাবে আলোচনা ব্যর্থ হয়।”

সেদিন ব্যারিকেড প্রতিরোধকামী জনতা লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক-বল্লম, এমন কি বন্দুকও সঙ্গে করে এনেছিল। স্থানীয় শিক্ষানুরাগী কাজী আজিমউদ্দিন আহম্মদ, সালাম, সেকান্দার মনিরুজ্জামানসহ আরও কয়েক ব্যক্তি বন্দুক নিয়ে সেদিন উপস্থিত হন। জাহানজেবের সঙ্গী পাঞ্জাবিরা গুলি করতে করতে অগ্রসর হলে তারা পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। এসময় দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ টন ক্ষমতাবিশিষ্ট একটা ট্রাক টাঙ্গাইলে রেশন পৌঁছে দিয়ে ভাওয়াল রাজবাড়ি সেনা ছাউনিতে ফিরছিল। এতে হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমানসহ ৫ জন বাঙালি সৈনিক ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে ছিল ৪টি চাইনিজ ও ১টি এসএমজি। প্রতিরোধকামী জনগণের মনোভাব টের পেয়ে আর তাদের অনুরোধে মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থক এই ৫জন সৈনিক তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঞ্জাবি সৈন্যদের ওপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। ফলে উভয় পক্ষে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির পক্ষ থেকে এটাই ছিল প্রথম গুলিবর্ষণের ঘটনা। পাঞ্জাবি সৈনিকদের গুলিবর্ষণে সেদিন জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হন মনু মিয়া নামে একজন দর্জি ও নিয়ামত নামে এক কিশোর এবং গুলিতে আহত হন সন্তোষ মল্লিক, ডা. ইউসুফ, শাজাহানসহ আরো ক’জন। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধকালে জয়দেবপুর চৌরাস্তার কাছের রাজপথে জনতার ব্যারিকেড অপসারণে উদ্যত এক পাঞ্জাবি সৈনিককে জাপটে ধরে তার রাইফেল কেড়ে নেন এক যুবক। সেই যুবক অপর এক পাকিস্তানি সৈনিকের গুলিতে সেখানেই শহীদ হন; সেই অমিততেজি বীর যুবক হলেন হুরমত আলী। এছাড়া কানু মিয়া নামে এক ব্যক্তিও গুলিবদ্ধ হন চৌরাস্তায় এবং বেশ কিছুদিন পর চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনিও মারা যান। চৌরাস্তায় নেতৃত্ব দেন অ্যাড. হযরত আলী, আবদুস সাত্তার মিয়া, আসকর আলী সরকার, অধ্যাপক বারী, ইমান উদ্দিন, সফিউদ্দিন প্রমূখ।
চৌরাস্তায় গোলাগুলি করার পর পাঞ্জাবি সেনারা টঙ্গীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

টঙ্গীতে তারা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। টঙ্গীতে নেতৃত্ব দেন কাজী মোজাম্মেল হক, আহসান উল্লাহ মাস্টার, আঃ মান্নান পাঠান, আজমত উল্লা খান, সফদর আলী মাস্টার, গাজী আঃ লতিফ প্রমূখ। বহু কষ্টে মারমুখী বাঙালির এইসব প্রতিরোধ মোকাবেলা করে পাকিস্তানি সেনাদের সেদিন ঢাকা প্রত্যার্বতন করতে হয়েছিল। জয়দেবপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,‘ তারা যদি ভেবে থাকে যে বুলেট ও শক্তির মাধ্যমে জনতার আন্দোলনকে দমন করতে পারবে তবে তারা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছে। বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তার অর্থ এই নয় যে, তারা শক্তি প্রয়োগকে ভয় পায়। জনগণ যখন রক্ত দিতে তৈরি হয়, তখন তাদের দমন করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই।’ সেদিন রাত্রে মোঃ হাবিবুল্লাহ-এর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এই প্রতিরোধ যুদ্ধে জয়দেবপুর বাজার-তিন সড়ক-চৌরাস্তা-টঙ্গী এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জয়দেবপুরে দীর্ঘ ২৯ ঘন্টা কার্ফু জারি করে রাখে। কার্ফু উঠিয়ে নেয়ার পর পরই বিক্ষব্ধ জনতা আবার পথে নেমে আসে এবং ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে শুরু করে। কেননা বঙ্গবন্ধু নিজেই ৭ মার্চের ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রস্তুতিও সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ জয়দেবপুরের জনপদের মানুষকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সহায়তা করেছিল।

গাজীপুর সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের নামের তালিকা পূর্ণাঙ্গভাবে তৈরি হয়নি। সেদিনের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের আহত সন্তোষ কুমার মল্লিক বলেন, আমাদের দুঃখ আমাদেরকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। প্রশ্ন তোলেন তিনি, কেন তাদের কথা ভুলে যাওয়া হচ্ছে? এদিকে যুদ্ধাহত ( ১৯ মার্চ ১৯৭১ ) আরেকজন ডাঃ ইউসুফ আলী সরকারের সন্তান আসাদুল আলম সরকারের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান ‘আমার বাবা এখনো কোনো ধরনের স্বীকৃতি পান নি।

মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তৎকালীন ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের উদ্যোগে ঢাকা-মযমনসিংহ-টাঙ্গাইল ও গাজীপুর সড়কের মিলনস্থল চান্দনা চৌরাস্তায় মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক (এক হাতে রাইফেল অপর হাতে গ্রেনেড) সম্বলিত দেশের সর্বোচ্চ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নির্মাণ করা হয়। এদিকে স্মারক হিসেবে নির্মাণ করা হয় জয়দেবপুর বাজারে ‘মুক্তমঞ্চ’। প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ নিয়ামত ও মনু খলিফার পবিত্র স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাহিদ আহসান রাসেল এমপি।

তৎকালীন সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ হাবিবুল্লাহ (তখন স্থানীয় রাণী বিলাসমনি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন) স্কুল হোস্টেলের যে কক্ষটিতে থাকতেন এবং জয়দেবপুরের তখনকার সরকারী পশু চিকিৎসক ডাঃ আহমদ ফজলুর রহমানের বাসা এ দুটো জায়গা হয়েওঠতো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ওই দুই জায়গায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিদিন হরতাল সফল করা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য মিলিত হতেন। এ দুটি জায়গা ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাই না।

এদিকে আজকের ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য জয়দেবপুরের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের পটভূমিসহ বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত মুদ্রিত বই প্রকাশ করা খুবই জরুরী, যার দায় আমরা এড়াতে পারি না। জাতীয়ভাবে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস দ্রুত সংরক্ষণ করা না হলে ভবিষ্যতে অনেক খন্ড খন্ড তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। জয়দেবপুরের একাত্তরের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ১৪ জন সদস্যের মধ্যে ইতোমধ্যে আট জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন, আর মাত্র ছয় জন সদস্য মাত্র জীবিত রয়েছেন। তাঁরা মারা যাওয়ার পর খন্ড খন্ড তথ্য খুঁজে পাওয়া নাও যেতে পারে। এ রকম সংশয় থাকা স্বাভাবিক। এই সকল বিষয় বিবেচনায় রেখে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এবং প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের অগ্রনায়ক আ. ক. ম. মোজাম্মেল হককে সবিনয় অনুরোধ করছি। পাশাপাশি শুধুমাত্র একদিন (১৯ মার্চ ) বেশ ভিন্নমাত্রায় অনুষ্ঠান করলেই ইতিহাস সংরক্ষণ হয় না। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে ইতিহাস সৃষ্টিকারী কীর্তিমান ব্যক্তিদের মর্যাদা দিতে হবে, তা না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। কেননা এই কীর্তিমান ব্যক্তিরাই মানুষের মনে বেঁচে থাকেন অনন্তকাল।

লেখক: সংগঠক , মুজিব আদর্শ কেন্দ্র ও গাজীপুরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ডিজিটাল সংগ্রহশালা আর্কাইভস ৭১ - এর প্রতিষ্ঠাতা। 

বহুমাত্রিক.কম