Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেরিন ড্রাইভকে ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনা

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৫:৫১, ২১ জুলাই ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

মেরিন ড্রাইভকে ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনা

ছবি: লেখক

পর্যটন মানে পরিব্রাজন, ভ্রমণ। পর্যটন মানে বেড়ানো। বেড়ানোর মাধ্যমেও অনেক সময় অনেক কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। এ পর্যটন করতে গিয়েই কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। এ সম্পর্কে অনেক বেদবাক্য জনশ্রুতি হিসেবে রয়েছে। ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু’ তেমনি একটি জনশ্রুতি।

এসব কথার একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে। সেটি হল আমরা সাধারণত বেড়ানো বলতে শুধু বিদেশ বিভুইকে বুঝে থাকি। কিন্তু আমাদের দেশের অভ্যন্তরে যে কত-শত সুন্দর সুন্দর উপভোগ্য স্থান রয়েছে সেটা মানতে পারিনা। এ প্রসঙ্গে এখানে আমি একটি বাস্বব উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করব।

আমি সম্প্রতি আমার নিজের কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের একটি পর্যটক দল নিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন নগরীখ্যাত কক্সবাজারে পরিভ্রমণ করি। সেখানে ভ্রমণের এক পর্যায়ে বিভিন্ন জনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার সময় একজনকে বলতে শুনেছি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। সেখানে রিক্সায় চড়ার সময় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। তখন সেই রিক্সাওয়ালা বলে উঠল, ‘এত দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ যে কেন এখানে ছোটে আসে বুঝি না। কী আছে এ বালি ও নোনা পানির ভিতর! কই আমরা তো জন্মের পর থেকে এখানেই আছি, তা তো কিছুই আমরা পাই না’।

আবার যদি আরেকটি কথা চিন্তা করি তাহলে তা কেমন হবে! প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যায়। তারা দু-চার দিনের জন্য সেখানে গিয়ে মানসিক উত্তেজনার মধ্যে কাটায়। কিন্তু যারা সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা কিংবা যারা চাকুরীর পোস্টিং নিয়ে সেখানে যায় তারা হয়তো পর্যটকদের মতো উত্তেজনা অনুভব করবে না সেটাই স্বাভাবিক।

যাহোক, পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মনের খোরাক জোগার করে এবং ভ্রমণের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে থাকে। আমাদের দেশে যে অনেক পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বৃহত্তর সিলেটের চা বাগন, সিলেট ও কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা, সারাদেশের বিভিন্ন পুরাকীর্তি, ঐতিহাসিক স্থানসমূহ, বিশ্ব ঐহিত্য হিসেবে সুন্দরবন, সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, সিলেটের লাউয়াছড়া প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, পাহাড়, নদী, খাল-বিল ইত্যাদি কত না কি। চট্টগ্রামে রয়েছে পতেঙ্গা সী বীচ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এটির দৈর্ঘ হলো প্রায় ৯৬ মাইল বা ১২০ কিলোমিটার।

সম্প্রতি এর সৌন্দর্য সঠিকভাবে উপভোগ করার সুযোগ সৃষ্টির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি দৃষ্টিনন্দন দুই লেনের আধুনিক সড়ক উদ্বোধন করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেরিন ড্রাইভ উদ্বোধন করছেন দেশবাসীর সাথে আমিও খবরটি মিডিয়ার কল্যাণে তখনই জানতে পেরেছি। এটি দেশের উন্নয়ন পরিক্রমায় আরেকটি সংযোজন হিসেবে উল্লেখ কওে তখন আমার একটি কলামে লিখেওছিলাম। কিন্তু তখন এটি সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে আমার পুরোপুরি কোন ধারণা ছিলনা। আমি মনে করেছিলোম, হয়তো সমুদ্রে কোন স্টিমার বা জাহাজ দিয়ে ড্রাইভ হবে। আমার মনে হয় দেশের অনেকেরই হয়তো একইরকম অনুমান কিংবা ধারণা হতে পারে।

সেজন্য এবার যখন আমি আমার পরিবারসহ সহকর্মীদের নিয়ে মেরিন ড্রাইভে যাব বলে ঠিক করেছি কক্সবাজার, তখনো আমার একই ধারণা বিরাজমান ছিল। যখন সেখানকার বিশেষ ধরনের চান্দের গাড়িখ্যাত খোলা জিপে করে সারাদিনের জন্য ৮০ কিলোমিটার রাস্তা আসা-যাওয়ার জন্য উঠি তখন আমার ভুল ধারণা ভাঙ্গে। সে এক অসাধারণ অনুভুতি। আমরা সবাই মিলে প্রায় ৩৬ জনের মতো ছিলাম। তিনটি চান্দের গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ি বহু প্রত্যাশিত ও প্রতীক্ষিত মেরিন ড্রাইভে। আমাদের আগ্রহের কাছে দিনভর মুষলধারে বৃষ্টি কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সেখানে গেলে কী যে এক অনুভুতির সৃষ্টি হয় তা বলে বুঝানো কঠিন। গর্বে বুকটা ফুলে উঠে এই ভেবে যে আমাদের বাংলাদেশে এমন একটি পর্যটন সম্পদ রয়েছে। পুরো ৮০ কিলোমিটার রাস্তা ধরেই চোখের দৃষ্টি অন্যত্র ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সীমান্ত হয়ে সাবরাং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত এ মেরিন ড্রাইভের রাস্তাটি। কক্সবাজার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই উষ্ণ উত্তেজনা। উত্তেজনার প্রধান কারণ ও আকর্ষণ ছিল যাওয়ার পথে রাস্তার বামপাশে পাহাড় আর ডানপাশে সাগর। সাগরের ছোট ছোট ঢেউ মনের গহীনে তীব্র সমুদ্রের বিশালত্বের আনন্দের অনুভুতি এনে দিচ্ছিল বারবার। অপরদিকে পাহারগুলি মনে হলো পর্যটকদের দিকে মাথা হেলিয়ে কুর্নিশের ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে। নতুন নির্মিত রাস্তাটিতে এমনভাবে যেন গাড়ী চলছে যেখানে পিন পতনের শব্দ ও ঝাঁকুনিটি পর্যন্ত নেই। মনে হলো পর্যটনকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এমন একটি উদ্যোগেরই প্রয়োজন ছিল এতদিন।

উপাচার্য মহোদয়সহ একটি চান্দের গাড়িতে সপরিবারে আমরা ১২ জন উঠেছিলাম। গাড়িতে যাওয়ার সময় আমরা উত্তেজনায় একেকজন একেক কথা বলছিলাম। ডানপাশে সাগরের অংশে মাঝে মাঝেই ঝাউ গাছের সারি। জানা গেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর বঙ্গবন্ধুই নাকি সাগরের কুল রক্ষার জন্য সারি সারি ঝাউবন সৃজন করেছিলেন। ঝাউবন দুটি কাজ করে থাকে। একটি হলো সামুদ্রিক ঝড়ের বাতাস থেকে কিছুটা হলেও উপকূলবাসীকে রক্ষা করে থাকে, অপরদিকে ঢেউয়ের তোড়ে যাতে পাড় ভাঙ্গতে না পারে সেটিার নিরাপত্তা বেষ্টনি হিসেবে কাজ করে থাকে। অনেককে বলতে শুনেছি, সাগর পাহাড় ইত্যাদি স্থানে নাকি শুষ্ক বা শীতকালে বেড়াতে হয়। কিন্তু বর্ষাকালে যে অন্যরকম অভিজ্ঞতা সেটা সেসময় সেখানে গিয়েই বুঝতে হবে। যদি মানুষের কথা শুনে ভয়ে এসময়ে সেখানে বেড়াতে না যেতাম তাহলে আরেকটি অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত থেকে যেতাম।

এমনিতে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রথাগত লাবণী পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট এবং একটু অদূরে ইনানী ও হিমছড়ি বীচের দিকেই পর্যটকদের ঢল সবচেয়ে বেশি। আর সেজন্য এসব বীচ পয়েন্টকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন তারকা বিশিষ্ট হোটেল, মোটেল, রেস্ট হাউজ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। বেড়ানোর জায়গার তুলনায় পর্যটক সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে এসব স্থানে অনেক ভিড় হয়ে পড়ে। কিন্তু মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে যে রাস্তা করা হয়েছে সেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৮০ কিলোমিটার একসাথে সমুদ্র ও পাহাড় দর্শন একত্রে হয়ে যাচ্ছে। সেখানে যেতে যেতে সৈকতে সাম্পান নৌকার মাধ্যমে মাছ ধরার দৃশ্য দেখার দৃষ্টান্ত বিরল।

পৃথিবীর এমন অনেক দেশ আছে যেখানে তাদের মোট দেশজ অর্থনীতির প্রধান আয় আসে পর্যটন খাত থেকে। দূরদেশ ইউরোপ আমেরিকা ছাড়াও আমাদের পাশ্ববর্তী ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, চীন ইত্যাদি প্রধান। বাংলাদেশের যে পর্যটন সম্ভাবনা রয়েছে সর্বশেষ সম্ভবনাময় সংযোজন হলো এ মেরিন ড্রাইভ। এখন সেখানে প্রয়োজন শুধু দেশি বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের উপযোগী সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ভৌত অবকাঠামো তৈরী করা।

একটি জিনিস আমরা সবাই জানি, পর্যটন একটি বিরাট খাত। সেখানে শুধু সরকারের পক্ষে এর সপক্ষে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা সম্ভবপর নয়। বিশ্বের কোন দেশেই তা একা সরকারের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। সরকার শুধু একটি পথ বাতলে দিতে পারে মাত্র। কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভের রাস্তাটি তৈরী করে দেওয়া সেই উদ্যোদেরই একটি অংশ মাত্র। সরকার সেখানে সেকাজটিই করে দিয়েছে। কাজেই এ খাতের দ্রুত উন্নয়নের জন্য ব্যাপক দেশি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। সেটির উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে হবে বেসরকারি খাতকেই।

সেখানে বেসরকারীভাবে পর্যটকদের জন্য বিনিয়োগ করে ব্যাপক লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আশি কিলোমিটার রাস্তার পাহাড়ের অংশে অনেক ফাঁকা জায়গা রয়েছে যেখানে ইচ্ছে করলেই পরিকল্পিতভাবে পর্যটনবান্ধব স্থাপনা, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলা সম্ভব। সরকার শুধু এসবের জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করবে এবং তদারকি করবে। তবে আমরা মেরিন ড্রাইভের সময় রাস্তার পাশে কিছু দখলী সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেন্টুন ইত্যাদি দেখেছি। এগুলো যদি সত্যি সত্যি পরিকল্পিতভাবে পর্যটন সহায়ক স্থাপনা তৈরীর উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাহলে তো কোন কথাই নেই। আর যদি সেগুলো অবৈধ দখলদার হয়ে থাকে তাহলে কোন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টির আগেই সেগুলোর বিষয়ে সরকারকে কঠোর ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। তা না হলে পর্যটনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা শুরুতেই হোঁচট খাবে।

এমনিতেই বিভিন্ন অজুহাতে সারাদেশে সরকারি সম্পত্তি ও জায়গা দখলের যেমন মহোৎসব চলে এখানে যেন তা না হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সচেতন সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আমি এখন থেকে মাত্র ৫ বছর আগে ২০১২ সালে একবার কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরের। এখনকার ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী আরো ৫-১০ বছরে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এভাবেই বাংলাদেশ এখন তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ থেকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে। সেই ধারা আরো বেগবান হয়ে পুরো বাংলাদেশ একটি পর্যটন নগরীতে পরিণত হোক-এটাই তো আমাদের স্বপ্ন হওয়া উচিত।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer