Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভয়াল ১২ নভেম্বর : যে ক্ষত আজও বয়ে বেড়ায় ভোলাবাসী

আকতারুজ্জামান সুজন

প্রকাশিত: ০২:২২, ১২ নভেম্বর ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

ভয়াল ১২ নভেম্বর : যে ক্ষত আজও বয়ে বেড়ায় ভোলাবাসী

ছবি : সংগৃহীত

ভোলা : নদীর মোহনায় ক্রিকোনাকৃতি জেগে ওঠা বাংলাদেশের দ্বীপ জনপদ ভোলা । এ জেলার পূর্বে মেঘনা, উত্তরে ইলিশা, পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদী আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এর মাঝে ৩ হাজার ৪শ ৩ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই দ্বীপ জনপদের বিস্তৃতি। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে সাতক্ষীরা জেলার হরিণভাঙ্গা নদীর থেকে আরম্ভ করে পূর্বাংশে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত যে তটরেখা, সেটাই বাংলাদেশের উপকূল।

সাগরের তীরে অবস্থিত জোয়ার ভাটার জায়গাকে সাধারনত উপকূল হিসাবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ব্যপ্তি প্রায় ৭০০ কিলোমিটার। দেশের এক-দশমাংশ এলাকা উপকূল। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করেন গড়ে ৭৪৩ জন মানুষ।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০ বছরে অন্তত ৬৪ বার মনে রাখার মতো বড় ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। ফলে ভোলার উপকূলের জনগণকে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে জীবন যাপন করতে হচ্ছে আবহমান কাল ধরেই। পানির স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে মৌসুমী ঝড়ের হারও বেড়েছে।

আবহাওয়া অধিদফতরের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে ২০টি নিন্মচাপ হয়েছে। এ সকল নিন্মচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ১২ টি। অথচ এর পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ৩৯টি নিন্মচাপ হয়েছে। আর এ থেকে ঘূর্ণিঝড় হয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে ২০০৯ সাল ছিল সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ বছর। ওই বছর বঙ্গোপসাগরে নয়টি নিন্মচাপ সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে থেকে দু’টি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা সৃষ্টি হয়েছে। এ দু’টি ঘূর্ণিঝড় উপকূলের জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। যে ক্ষতি আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে “ভোলা সাইক্লোন” নামে খ্যাত ঘূর্ণিঝড়। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ এবং সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সমুদ্র সমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান।

এটি সিম্পসন স্কেলে “ক্যাটাগরি ৩” মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় এবং ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এর গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে (১১৫ মাইল) পৌঁছায় এবং সে রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। এতে ওইসব এলাকার ঘর-বাড়ি, গ্রাম ও শস্য স্রোতে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। সেখানে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ৭৭ হাজার জনই প্রাণ হারায়।

২০০৯ সালের ২৫ মে “ঘূর্নিঝড় আইলা” ভোলার উপকূলে আঘাত হানে। এতে মুহুর্তের মধ্যে ভোলা সদর, মনপুরা ও চরফ্যাসন উপজেলায় ৩০হাজার ঘড়-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। সেখানকার ৪৫গ্রাম লন্ড ভন্ড হয়। জলোচ্ছাস হয় ৬/৭ফুট উচ্চতায়। পানিতে ভেসে যায় কয়েক’শ মাছের ঘের। বিনষ্ট হয় হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। ঝড়ে প্রাণ হারান ১৮জন। বেড়ি বাধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ন জনপদ ও মানুষের ঘর বাড়ি।

ঢালচর ইউনিয়নের স্বজনহারা মজিবল মিয়া জানান, “ওই ঝড়ের সময় আমরা কেউ ঝড়ের পূর্বভাস পাইনী। যারফলে এখানে ক্ষয়-ক্ষতি বেশী হয়েছে। ঝড়টি মুহুর্তের মধ্যেই সব উপড়ে ফেলে। জেলে কয়েক’শ নৌকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।”

চর পালিতার ঘর-বাড়িহারা বিলকিছ বেগম বলেন, “বইন্যায় সব তলায়া লইয়া গেছে, তিন দিন দইর্যাক না খাইয়্যা আছিলাম। কোলের পোলাডারে (ছেলে) বনরুডি (পাউরুটি) খাবাইয়্যা বাচাঁইয়া রাইখছি। এমন বইন্যার কথা কি ভূইলা যাইতে পারি?”

সেদিনের ভয়াবহ কথাগুলো বলতে গিয়ে চরফ্যাসন উপজেলার কুকরী-মুকরী ইউনিয়নের মতলব মাঝি (৪২) জানান, “দুদিন দইর্যা না খাইয়্যা আছিলাম। ঘরবাড়ি সব ডুইব্যা আছিলো। পোলাইন ছালাইন নিয়া বেড়িরপাড়ে (বেড়িবাধ) খাইয়্যা না খাইয়্যা দিন পার করছি।”

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer