Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

পরিত্যক্ত প্লাষ্টিকে ধানের ঢোল-বেড়ি : পৃষ্ঠপোষকতা চান কারিগররা

তুহিন আহামেদ, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০২:৪২, ১৩ মে ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

পরিত্যক্ত প্লাষ্টিকে ধানের ঢোল-বেড়ি : পৃষ্ঠপোষকতা চান কারিগররা

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

গাজীপুর-সাভার ব্যুরো : দেশের প্রায় প্রত্যেকটি অঞ্চলেই চলছে ধান কাটার মহোৎসব। কষ্টার্জিত এ ফসল ভাল ভাবে সংরক্ষণে কৃষকের চিন্তার শেষ নেই। তাই এ ধান সংরক্ষণ করার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বাঁশ দিয়ে তৈরী বিভিন্ন ধরণের ঢোল কিংবা বেড়ী তৈরী করে থাকেন।

বিভিন্ন অঞ্চলে শুধু বাঁশ দিয়ে ঢোল কিংবা বেড়ী তৈরী হলেও আশুলিয়ার শিমুলিয়াতে এটি তৈরী হচ্ছে টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিলের পরিত্যক্ত প্লাষ্টিক জাতীয় ওয়ান টাইম বেল্ট থেকে। আর এ ঢোল বেড়ীতেই জিবীকা নির্বাহ করছে স্থানীয় বহু পরিবার।

এখানে এর বেশী চাহিদা থাকলেও অর্থের অভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঢোল/বেড়ী সরবরাহ করতে পারছেন না এখানকার কারিগররা। তবে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংক কিংবা কোন এনজিও প্রতিষ্ঠান সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করলে হয়তো এ হস্তশিল্পটি আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব হতো বলে দাবি এখানকার কারিগরদের।

সরেজমিনে আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউপি’র গণকপাড়া এলাকায় গিয়ে কথা হয় এ শিল্পের মহাজন পৌল সরদারের সঙ্গে। সাতক্ষীরা জেলার পাটকেলঘাটা থানাধীন সেনেরগাতি গ্রামের মৃত. নরেন্দ্র সরদার এর ছেলে পৌল সরদার(৬০)। গ্রামের বাড়িতে অন্যান্যদের মতো তিনিও বাঁশ দিয়ে তৈরী ধান রাখার ডোল, বেড়ী, ঘরের সিলিং এর তালাই তৈরী করতো। গেল ১০ বছর আগে জিবীকার তাগিদে মানিকগঞ্জে এসে পাড়ি জমান। সেখানে এসে এক মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়েদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যেমন- ঢাকা, গাজীপুরের টঙ্গী, মাওনা শ্রীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ঝুট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিলের পরিত্যাক্ত প্লাষ্টিকের ওয়ান টাইম বেল্ট কেজি হিসেবে কিনে আনত।

পরে সেগুলো প্রথমে নিজেই বাঁশের ডোল/বেড়ীর মত প্লাষ্টিকের পরিত্যাক্ত ওয়ানটাইম বেল্ট দিয়ে ঢোল/বেড়ীর তৈরী করতো। প্রথমে এর চাহিদা কম ছিল। তবে লোকজন এসব ডোল/বেড়ী ধান রাখার জন্য নিতে থাকে। এর একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাঁশ দিয়ে তৈরী ধান রাখার ডোল কিংবা বেড়ী ইঁদুরে কেটে ফেললেও টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিলের পরিত্যাক্ত প্লাষ্টির ওয়ান টাইম বেল্ট দিয়ে তৈরী ডোল /বেড়ী কাটতে পারেনা। ফলে দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়তে থাকে।

পৌল সরদার জানান, গত ৪ বছর আগে আশুলিয়ার শিমুলিয়া গণকপাড়া এলাকার বদরুল আলমের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু করেন। ঢাকা, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিলের পরিত্যাক্ত ওয়ান টাইম বেল্ট সংগ্রহ করে থাকেন। তবে তিনি এগুলো সরাসরি কারখানা থেকে সংগ্রহ করেন না। এগুলো তিনি ঝুট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা দরে ক্রয় করে থাকেন। পরে শ্রমিকদের মাধ্যমে এগুলো দিয়ে ধান রাখার ডোল/বেড়ী, ঘরের সিলিং, রান্না ঘরের চাল সহ নানা জিনিস তৈরী করে থাকেন। একেকটি ধান রাখার ডোল বা বেড়ী তৈরী করতে ৩ থেকে ৪ দিনের মত সময় লাগে একজন শ্রমিকের। আর এ শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন প্রতি কেজি ২৫ টাকা দরে। একজন শ্রমিক প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কেজির মত কাজ করতে পারেন।

পরে এগুলো আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন এসে কিনে নিয়ে যায়। প্রতি কেজি বিক্রি করা হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। যা থেকে প্রতিমাসে তার ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মত আয় হয়।

কথা হয় এখানে ডোল/বেড়ী বানানোর কারিগর সত্তরঞ্জন বিশ্বাস এর সাথে। তিনি জানান, তার বাবা ক্ষিতিশচন্দ্র বিশ্বাস ও তার স্ত্রী রুজি বিশ্বাসও এখানে তার সাথে বেড়ী/ঢোল বানানোর কাজ করে থাকেন। ২৫ টাকা কেজি দরে সে এখানে কাজ করে থাকেন। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি বেড়া আবার কোন কোন দিন ৫/১০ কেজি বেড়া তৈরী করে থাকেন। এ থেকে যা পাওয়া যায় তা দিয়েই তার সংসার চলে।

সত্তরঞ্জন এর স্ত্রী রোজি বিশ্বাস জানান, তার স্বামীর মতো সেও এখানে ঢোল/বেড়ি বানানোর কাজ করে থাকেন। সেই সাথে তিনি ঘরের সিলিং, রান্না ঘরের চালও তৈরী করে থাকেন প্লাষ্টিকের এ বেল্ট দিয়ে। একটি পূর্ণাঙ্গ ধান রাখার ডোল তৈরী করতে তার ৪/৫ দিন সময় লাগে। আবার ধান রাখারবেড়ী তৈরী করতে তার ৩দিন এর মত সময় লাগে। এ থেকে যা পায় স্বামী সন্তান ও শ্বশুরকে নিয়ে সংসার চলে যায় তাদের। এ থেকেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।

সত্তরঞ্জন এর পিতা ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, দুই বছর আগে এখানকার মহাজন তদেরকে গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। এখানে ছোট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ডোল/বেড়ি, ঘরের সিলিং, বেড়াসহ নানা জিনিস বানিয়ে থাকি। কাজের মজুরি কেজি হিসেবে দেওয়া হয়। দিনে থেকে ৭ কেজি বেড়া বানাতে পারি। এছাড়া এখানে আমি সহ আমার ছেলে ও ছেলের স্ত্রী কাজ করে থাকে।

ধামরাইয়ের গোলাইল থেকে ধান রাখার বেড়ি কিনতে আসা হাজী মো. আবুল হোসেন নামের এক ক্রেতা জানান, গত বছর আমার ছোট দুই ভাই আশুলিয়ার শিমুলিয়া গণকপাড়া থেকে ধান রাখার জন্য বেড়ি ও ডোল কিনে নিয়ে যায়। পরে তাদের কাছে শুনে ঠিকানা নিয়ে এখানে এসেছি। আমি একটি বেড়ি কিনেছি। যার ওজন হয়েছে ৩৮ কেজি এবং দাম দিয়েছি ৩ হাজার ৮’শ টাকা।

তিনি জানান, নি:সন্দেহে এটি একটি ভাল উদ্যোগ। কারণ আমরা সব সময় বাঁশের তৈরী বেড়ি ও ডোল এর মধ্যে ধান সংরক্ষণ করে থাকি। তবে এগুলো বেশীদিন ব্যবহার করা যায়না, ইঁদুরে কেটে ফেলে। ফলে ধান নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এখানকার প্লাষ্টিকের তৈরী ডোল/বেড়িতে ধান রাখলে কোন নষ্ট হয়না। ইঁদুরেও কাটেনা। ফলে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়।

আর্থিক অসচ্ছলতার অভাবে এ ব্যবসা দীর্ঘদিন হয়তো করা সম্ভবপর হবে না। মহাজন ও কারিগরদের দাবি, এ অঞ্চলে প্লাষ্টিকের বেল্টের তৈরী ডোল, বেড়ি, বেড়া ও ঘরের সিলিং এর ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও তৈরী করা যাচ্ছেনা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। এশিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি ব্যাংক ও এনজিওগুলো যদি সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে তাহলে তাহলে এটি আরও এগিয়ে যাবে। বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer