Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ছানা’র গ্রাম সাদুল্ল্যাপুর

তুহিন আহামেদ, গাজীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০১:৪০, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

ছানা’র গ্রাম সাদুল্ল্যাপুর

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

গাজীপুর : মিষ্টি খেতে কে না পছন্দ করেন। কেউ বা আবার অপছন্দও করেন। কারণ যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের মিষ্টি খেতে বারণ। তাদের জন্যও বিশেষভাবে নন ফ্যাট যুক্ত মিষ্টির ছানা তৈরী করে থাকেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সাদুল্ল্যাপুরের ছানা কারিগররা।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় ঢালজোড়া ইউনিয়নে এ গ্রামটির অবস্থান। এ গ্রামে এক থেকে দেড়’শ লোকের বাস। যাদের সকলেই সংখ্যালঘু। কেউ ঘোষ, আবার কেউ গোপ, কেউবা বণিক। এ গ্রামের অধিকাংশ লোকের পেশা মিষ্টির ছানা ও ঘি তৈরী করে বিক্রি করা।

ছানা বা ঘি বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করেন এ গ্রামের কারিগররা। সাদুল্ল্যাপুর গ্রামের প্রায় ৫০ টি পরিবার প্রত্যক্ষভাবে এ পেশার সাথে জড়িত। তবে ছানা বা ঘি তৈরির জন্য তাদের নেই আলাদা কোন কারখানা বা প্রতিষ্ঠান। তারা সকলেই নিজ নিজ বাড়িতেই স্বল্প পরিসরে জায়গা নিয়ে তৈরি করে থাকে ছানা বা ঘি।

পরিবারের সকল সদস্যরাই এ কাজে নিয়োজিত থাকে। বাড়ির গৃহীনি থেকে শুরু করে ছেলে মেয়েরাও সহযোগিতা করে থাকে। আবার যার ছানা তৈরির পরিমাণ বেশি সে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে কাজ করে থাকে। এতে করে ওই এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

সাদুল্ল্যাপুর গ্রামের কারিগররা সারাদিনই ব্যস্ত থাকে ছানা, ঘি তৈরিতে। এখানকার ছানা ও ঘি গাজীপুরের টঙ্গী ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। জেলার টঙ্গীতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সাদুল্ল্যাপুর গ্রামের ছানা বা ঘি’র। ছানা তৈরির জন্য প্রথমে বড় একটি পাত্রে দুধ জাল করা হয়। অনেকক্ষণ জাল দেয়ার পর দুধে যখন ফেনা উঠে তখন সমস্ত দুধগুলো অন্য একটি পাত্রে ঢালা হয়।

এরপর ওই পাত্রে টক পানি মিশিয়ে ঠান্ডা করা হয়। পরে মিশ্রিত দুধ আর টক পানি থেকে ছেঁকে সেখান থেকে ছানা বের করা হয়। পরে সেগুলো অনুপাতিক ওজন হারে কাপড়ের তৈরি বিশেষ ধরণের থলেতে ভরা হয়। সুই সুতা দিয়ে থলেটির মুখ বন্ধ করে চুড়ান্তভাবে প্রস্তুত করা হয়। পরে তা বিক্রির জন্য বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়।

সরেজমিনে ওই গ্রামের ছানা কারখানার বিশ্বজিৎ গোপ নামের এক কারখানা মালিকের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, পারিবারিকসূত্রে তিনি এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত। তার পিতা মৃত. দীন বন্ধু গোপ বিগত ২৮ বছর ধরে এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সে মারা যাবার পর গত ১০-১২ বছর ধরে তিনিই পারিবারিকসূত্রে এ পেশার হাল ধরেছেন। তার ছানা কারখানায় বর্তমানে ৮জন শ্রমিক কাজ করছে। এতে আরো ৮জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরও জানান, তার কারখানায় দুই ধরণের ছানা তৈরী করা হয়। ফ্যাট যুক্ত ছানা এবং ননফ্যাট এ দুই ধরণের ছানাকারখানায় তৈরী করা হয়ে থাকে। তবে ফ্যাটযুক্ত ছানার চেয়ে ননফ্যাট ছানার চাহিদা একটু বেশী।

বিশ্বজিৎ আরো জানান, এক মন দুধে প্রায় ৮কেজির মত ছানা উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি ছানা ২০০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা বিক্রি করে থাকেন। তবে ছানা তৈরী করতে প্রতিমন দুধে ১০০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রাম ময়দা মেশানো হয়ে থাকে।

তিনি জানান, ছানা তৈরী করতে লাকড়ির প্রয়োজন হয়। লাকড়ি না থাকলে ছানা তৈরী করা সম্ভম নয়। কারণ দুধ জাল করানোর জন্য লাকড়ি প্রয়োজন। কোন কোন সময় দুধের চাহিদা বেশী থাকলে পাউডার দুধও ব্যবহার করে থাকেন। আবার ময়দাও ব্যবহার করা হয়ে থাকে ছানা তৈরীতে। সবশেষে ছানা তৈরী করা হয়ে গেলে তা বাজারজাত করানোর জন্য একটি বস্তায় বিশেষভাবে সেলাই করে রাখা হয় এবং মিষ্টির কারখানায় পৌছে দিয়ে আসতে হয়। এতে প্রতি মন ছানার দাম পরে ৬হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা।

একই এলাকার ছানা ব্যবসায়ী ও কারিগর বিমল ঘোষ এর ছেলে সুমীর ঘোষ জানান, তাদেরও পারিবারিক ব্যবসা এটি। এ ব্যবসা করেই সংসার চলে তাদের। তার বাবা এর প্রধান কারিগর। বাবা’র কাছ থেকেই ছানা তৈরির প্রক্রিয়া তিনি শিখেছেন। তিনি জানান তাদের বাড়িতে মোট পাচঁজন শ্রমিক রয়েছেন। যারা নিখুতভাবে ছানা তৈরির কাজ করে থাকেন।

ছানা তৈরিতে বিশেষ ধরণের টক পানি ব্যবহার করা হয়। টক পানি তৈরি হয় ছানা থেকে। দুধ ঘন জাল করে পরে তা থেকে ছেঁকে ছানা বের হওয়ার শেষে অবশিষ্ট পানি টুকুই টক পানি হিসাবে পরিচিত। একটি বিশেষ ধরনের ড্রামে বা পাত্রে পানি ভরে সেটা পানির হাউজ বা পানির ট্যাঙ্কে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঠান্ডা করা হয়।

বিশ্বজিৎ গোপ ও সুমীর এর মত ওই গ্রামের আনন্দ (১), বিবেক, চিত্ত, বিমল, প্রসাধ, অপূর্ব, দৌড়া, বলরাম, আনন্দ (২), বিশনু, ভম্বল ও কার্তিক এর মত অনেকেই এ পেশার সাথে জড়িত। তাদের কারকানায় কাজ করে প্রায় অর্ধশত শ্রমিমের পরিবার চলে।

কথা হয় তাদের সাথে। তারা জানান, পারিবারিকসূত্রে তারা এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত। এ পেশায় তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ। ছানা বা ঘি বিক্রি করেই চলে তাদের সংসার। ছেলে মেয়েদের পড়ালেখাসহ যাবতীয় খরচের সংকুলান হয় ছানা বা ঘি বিক্রি করে।

এছাড়া ছানা ও ঘি তৈরির কাজে স্থানীয় যুবকরা কাজ করে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হচ্ছে আবার অন্যদিকে স্বচ্ছল জীবন যাপন সম্ভব হচ্ছে। আবার অনেকে স্থানীয়ভাবে এ কাজ শিখে নিজে নিজে ব্যবসা করার জন্য উৎসাহ পাচ্ছে। বিশেষ করে তরুনরা দিন দিন এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer