Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৮ ১৪৩১, শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪

প্রবাসী কবি ও চিকিৎসক নবী চৌধুরীর জীবনের কথকথা

শওকত আলী বেনু

প্রকাশিত: ০১:০১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

প্রবাসী কবি ও চিকিৎসক নবী চৌধুরীর জীবনের কথকথা

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

(প্রথম পর্ব)

লন্ডন : ক্যাপ্টেন (অব:) ডা. গোলাম নবী চৌধুরী। সহপাঠীরা ডাকতো `নবী ভাই` বলে। থাকেন যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডনের বো এলাকার চেরিউড ক্লজ। পঁচাত্তর পেরুনো এই নিউরোলোজিস্ট অবসর জীবনেও বেশ রোমান্টিক, কথা ও ভাবনায়। শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করা কাব্যচর্চা ধরে রেখেছেন এখনো। দু`হাত ভরে লিখে চলছেন কবিতা।

কেমন আছেন তিনি? জানতে চাইলে প্রফুল্লচিত্তে জানালেন `ভালোই আছি`। অতি সাধারণ এক মানুষ। জীবনের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন অনেক গল্প। বেঁচে থাকার গল্প। যুদ্ধের গল্প। পেশাগত জীবনের গল্প। হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাই বোন, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেককে। যুদ্ধে হারিয়েছেন প্রিয় সহকর্মীকে। চেয়েছেন সৎ জীবন যাপন করতে। কখনো হোঁচট খেয়েছেন। তবু অসৎ সঙ্গ বেছে নেননি। নতিস্বীকারে বাধ্য হননি দুষ্ট চক্রের কাছে। সততাই ছিল বেঁচে থাকার মূল হাতিয়ার।

দীর্ঘ আলাপচারিতায় প্রবাসী চিকিৎসক নবী চৌধুরী শুনিয়েছেন নানা গল্প। মাঝে মধ্যে সঙ্গ দিয়েছেন স্ত্রী বিক্রমপুরের মেয়ে আফরোজা চৌধুরী। বেশ ঘুচিয়ে কথা বলেন। সম্প্রতি এই দম্পতির সাথে পূর্ব লন্ডনের বাসায় আড্ডার চুম্বকাংশ তুলে ধরা হচ্ছে। কথা বলেছেন সম্পাদক শওকত আলী বেনু।

জীবনের ঘানি টেনে ক্লান্ত হলেও গোলাম নবী চৌধুরী এখনও মুষড়ে যাননি । শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের কথা ভেবে আজও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। কুষ্টিয়ার গোসাইন দুর্গাপুরের আড়পাড়া গ্রামের আব্দুল আজিজ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র নবী চৌধুরী। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়ায় ১৯৪০ সালের পহেলা জুলাই আড়পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

আড়পাড়া গ্রামের সেই মানুষটি এখন সময় কাটাচ্ছেন পূর্ব লন্ডনে নিজ বাসায়। পেশাগত জীবনের শুরুতে কাজ করেছেন পাকিস্তানের গিলগিট, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি ও বেলুচিস্তানে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চিত হয়েছে বর্ণ-বিবর্ণ কাহিনী।

মেডিকেল সাইন্স এ উচ্চতর ডিগ্রী নেন যুক্তরাজ্য ও জার্মানি থেকে। অভিজ্ঞতা রয়েছে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের । সেই যুদ্ধের স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ভুলতে পারেননি ক্যাপ্টেন কোরাইশী নামের সহযোদ্ধাকে, যিনি মাইন বিস্ফোরণে চোখের সামনেই মৃত্যুবরণ করেন। সেই বিস্ফোরিত মাইনের স্প্রিন্টার এসে বিদ্ধ হয় তাঁর ডান পায়ে।

নবী চৌধুরীর পিতা আব্দুল আজিজ চৌধুরী ১৯১৫ সালে মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান নিয়ে এন্ট্রেন্স পাশ করেন। নানা আতাউর রহমান চৌধুরী ছিলেন কুষ্টিয়ার জমিদার। কুষ্টিয়ার গোসাই দূর্গাপুরের আড়পাড়া গ্রামের `কুটিবাড়ি` ছিল ওই সময় ব্রিটিশ নীলকরদের আস্তানা।

সেই সময় বৃটিশ নীলকরেরা অত্যাচার আর নিপীড়নের মাধম্যে নীলচাষে বাধ্য করলে গড়ে ওঠে আন্দোলন । সেই আন্দোলনে যোগদেন তাঁর নানা আতাউর রহমান চৌধুরী। নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিদ্রোহ করায় কাঁঠাল গাছের সাথে ঝুলিয়ে ব্রিটিশরা নির্মমভাবে হত্যা করে জমিদার আতাউর রহমান চৌধুরীকে।

পাঁচ ভাই তিন বোন। নবী চৌধুরী সবার ছোট। হারিয়েছেন মা বাবা ভাই বোন সহ অনেক বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মী। নবী চৌধুরী কুষ্টিয়ার ইউনাইটেড মিউনিসিপালিটি হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন ১৯৫৫ সালে। মেট্রিকুলেশনের পর কুষ্টিয়া কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে।

তখন সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করেছেন। যোগদান করলেন পাকিস্তান আর্মি মেডিক্যাল কোরে, লেফটেনেন্ট পদে। তরুণ অফিসার। ১৯৬৫ সাল।শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। জানালেন, পেশাগত জীবনের শুরুটা হয় দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বদলি করে পোস্টিং দেয়া হয় পাকিস্তানের গিলগিট ও বেলুচিস্তান অঞ্চলে। কাজ করেন একটি রেজিমেন্ট এর সাথে চিকিৎসক হিসেবে। অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই বুলেটবিদ্ধ হন সেই যুদ্ধে।

যুদ্ধের সেই স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ভুলতে পারেননি এফএফ রেজিমেন্ট এর অফিসার ক্যাপ্টেন কোরাইশী (পাঞ্জাবি) নামের সহযোদ্ধাকে, যিনি মাইন বিস্ফোরণে চোখের সামনেই মৃত্যুবরণ করেন। সেই বিস্ফোরিত মাইনের স্প্রিন্টার এসে বিদ্ধ হয় তাঁর ডান পায়ে। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।

রক্তক্ষরণ হলেও, প্রাণে বেঁচে যান সেই যাত্রায়। ডান পায়ের হাঁটুর নিচের ক্ষতস্থান দেখিয়ে নবী চৌধুরী স্মরণ করেন ক্লাসমেট ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম এর কথা। সেই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম নামের ক্লাসমেটকেও চিরতরে হারান। ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম এবং নবী চৌধুরী দুই জনই ছিলেন একমাত্র বাঙালি।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ শেষ হয়। পরবর্তীতে পোস্টিং হয় পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি ও বেলুচিস্তানে। সুনামের সাথে কাজ করেন প্রতিটি স্থানে। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে বদলি হয়ে চলে আসেন যশোরে। বছর খানেক চাকুরি করে ১৯৬৯ সালে দেশ ছাড়েন। পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে।

(বাকি অংশ পরের পর্বে )

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer