ভারত যখন করোনাভাইরাসের বিধ্বংসী দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে লড়াই করছে, তার মধ্যেই গত মাসে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ হিন্দু সমবেত হয়েছিলেন হিমালয় অঞ্চলের শহর হরিদ্বারে কুম্ভমেলায়।তখনই আশঙ্কা করা হয়েছিল, এই কুম্ভমেলা এক `সুপার-স্প্রেডার ইভেন্ট` অর্থাৎ করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়ানোর একটি বড় অনুষ্ঠানে পরিণত হবে। খবর বিবিসির।
এখন সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে এটা অনেকেই বলছে । কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসা লোকজনকে পরীক্ষা করে কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ছে এবং তারা যে সম্ভবত আরও লোকজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়েছে, সে রকম খবর আসছে ভারতের অনেক এলাকা থেকে।মাহান্ত শংকর দাস হরিদ্বারে এই উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন ১৫ মার্চ। তখন ভারতের অনেক অংশেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।
উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার চার দিন পর, এপ্রিলের ৪ তারিখে ৮০ বছর বয়সি এই হিন্দু পুরোহিত কোভিড পজিটিভ বলে পরীক্ষায় ধরা পড়লেন এবং তাকে একটি তাঁবুতে ফিরে গিয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হলো।কিন্তু একাকী আলাদা থাকার পরিবর্তে মাহান্ত শংকর দাস তার ব্যাগ গুছিয়ে একটি ট্রেন ধরলেন এবং প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বারানসী পৌঁছলেন।
সেখানে স্টেশনে তার ছেলে নগেন্দ্র পাঠক তাকে নিতে এলেন এবং তারা আরও কিছু লোকের সঙ্গে একটি ট্যাক্সি শেয়ারে ভাড়া করে ২০ কিলোমিটার দূরের জেলা মির্জাপুরে তাদের গ্রামে পৌঁছলেন।মাহান্ত দাস দাবি করছেন, তার কাছ থেকে কেউ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়নি। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তার ছেলে এবং গ্রামের আরও কিছু মানুষের মধ্যে কোভিডের উপসর্গ দেখা গেল।
তার ছেলে নগেন্দ্র পাঠক জানালেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, কিন্তু গত দুই সপ্তাহে গ্রামে জ্বর ও কাশির উপসর্গ নিয়ে ১৩ জন মারা গেছে।এই গ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মাহান্ত দাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকতে পারে, আবার এটি নাও হতে পারে।
কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেছেন। যাত্রীর ভিড়ে ঠাসা একটি ট্রেনে ভ্রমণ করে, শেয়ারের ট্যাক্সিতে চড়ে তিনি হয়তো পথে পথে অনেক জায়গায় ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছেন।এপ্রিল মাসে হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় যোগ দেন ৯০ লাখের বেশি তীর্থযাত্রী।
রোগতত্ত্ববিদ ডা. ললিত কান্ত বলছেন, মাস্ক না পরে তীর্থযাত্রীদের বড় বড় দল যখন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার বন্দনা করেছে, তখন আসলে এটি দ্রুত ভাইরাস ছড়ানোর একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে।আমরা জানি, গির্জায় কিংবা মন্দিরে যখন সমবেত মানুষ একসঙ্গে কোরাসে গান গায়, সেটিও তখন একটি `সুপার-স্প্রেডার ইভেন্টে` পরিণত হয়।
হরিদ্বারের কর্মকর্তারা জানান, সেখানে দুই হাজার ৬৪২ তীর্থযাত্রী কোভিড-পজিটিভ বলে ধরা পড়েছিল; যাদের মধ্যে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতাও ছিলেন।
উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব, নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ এবং সাবেক রানি কমল শাহ এই কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসার পর পরীক্ষা করে তারাও কোভিডে আক্রান্ত বলে জানা গেছে। বলিউডের সংগীত পরিচালক শ্রাবণ রাঠোরও এই কুম্ভমেলা থেকে ফেরার কদিন পর মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালে মারা যান। মেলায় যোগ দিতে যাওয়া আরেকটি দলের ৯ হিন্দু ঋষি মারা যান।
কুম্ভমেলা থেকে ফেরা তীর্থযাত্রীরা অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কার মধ্যে কয়েকটি রাজ্য তাদের জন্য ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের বিধান চালু করে। যারা কুম্ভমেলায় যাওয়ার খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুশিয়ারি দেয়।
কোনা কোনো রাজ্যে এদের জন্য আরটি-পিসিআর টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু খুব কম রাজ্যেই আসলে কুম্ভমেলায় যাওয়া লোকজনের কোনো তালিকা আছে এবং কোনো রাজ্যেই এমন নিশ্ছিদ্র কোনো ব্যবস্থা নেই, যেটি দিয়ে তাদের সীমান্ত দিয়ে কে ঢুকছে আর কে বেরোচ্ছে সেটির ওপর নজর রাখা যাবে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে ভারতের সব জায়গা থেকেই এমন খবর আসতে শুরু করেছে যে কুম্ভমেলা থেকে ফিরে আসা লোকজনকে পরীক্ষা করে কোভিডের সংক্রমণ ধরা পড়ছে।মধ্যপ্রদেশের একটি শহরে কুম্ভমেলা থেকে ফেরা ৬১ জনের মধ্যে ৬০ জনের অর্থাৎ ৯৯ শতাংশই কোভিড-পজিটিভ পাওয়া গেছে পরীক্ষায়। কর্মকর্তারা এখন কুম্ভমেলা থেকে ফেরা আরও ২২ জনকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন।
ডা. কান্ত বলেন, এটা একটা ভয়ংকর বিপর্যয় ডেকে এনেছে।আর এই সংখ্যাগুলো আসলে ভাসমান বরফখণ্ডের চূড়ামাত্র। এই তীর্থযাত্রীরা যখন দলবেঁধে ভিড়ের মধ্যে ট্রেনে-বাসে ভ্রমণ করছেন, তখন কিন্তু তারা সংক্রমণের হার বাড়িয়ে দিচ্ছেন কয়েক গুণ।
আমি কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলতে পারি ভারতে যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এত বাড়ছে, তার একটি প্রধান কারণ এই কুম্ভমেলা।কুম্ভমেলার জন্য ১২ এপ্রিল ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একদিন। সেদিন গঙ্গা নদীতে স্নান করেছেন ৩০ লাখের বেশি মানুষ। হিন্দুদের বিশ্বাস এই গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে তারা মোক্ষলাভ করবেন।আর সেদিন ভারতে এক লাখ ৬৮ হাজার মানুষের কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ে। সংক্রমণের সংখ্যার দিক থেকে সেদিন ভারত ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে।
গত সপ্তাহে কুম্ভমেলার আয়োজকরা জানিয়েছিলেন, ৯১ লাখ তীর্থযাত্রী এবার হরিদ্বারে গিয়েছিলেন। উত্তরাখণ্ডে হাইকোর্ট বলেছিল-একটা ভয়ঙ্কর মহামারীর মধ্যে এই মেলার আয়োজন করতে দিয়ে এই রাজ্যটি সবার হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে। মেলার শুরু থেকেই এমন আশঙ্কা ছিল যে এটির আয়োজন করা মানে অনেক ঝুঁকি ডেকে আনা।