Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ১৯ ১৪৩২, শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫

মমতার জয়, পীরজাদা-শাহদের শঠতা ও আমাদের বরফগলার আশা

মোঃ আলফাজ উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৩:৫৩, ৫ মে ২০২১

প্রিন্ট:

মমতার জয়, পীরজাদা-শাহদের শঠতা ও আমাদের বরফগলার আশা

হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির দেশ অখণ্ড ঐতিহাসিক এই বাংলা। সমগ্র ভারতবর্ষে যে সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু বাংলায় তা নেই! বাঙালি সারাজীবন শিখেছে “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ”-নজরুল

এই মমতাকে হারানোর জন্যই মুসলমান ভোটকে বিভক্ত করার জন্য পীর সাহেবকে দিয়ে স্যেকুলার ফ্রন্ট করা হয়েছিল। পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মুসলমান ভোটের হিসাবটাই গোলমাল করে দিয়েছেন। মাথায় টুপি, মুখে দাড়িসমেত দৃশ্যত সাধারণ, ফুরফুরা শরিফের তরুণ এই পীরজাদা যে দলটি গড়েছেন, তার নাম ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ (আইএসএফ)। সে দলের সহসভাপতি মিলন মান্ডি নামে এক সাঁওতাল তরুণ।

এটাই ছিল পীরসাহেবের শঠতা। তিনি যদি বলেন, ‘বুঝি নাই’ তবুও এটা শঠতাই। ওদিকে কংগ্রেস ও বামেরা মাঠে নেমেছে যেন মমতার ভোট কাটা যায়। ভোটের ফলাফল তাই বলছে। কার্যত নিলজ্জভাবে বামেরা আর পীর সাহেবেরা বিজিপির বাক্সেই তাদের ভোট দিয়েছে। কিন্তু মমতাকে ঠেকানো যায়নি।

মমতা একা হাতে তার দলের গুরুত্বপুর্ণ নেতাদের বিজেপিতে যোগ দেয়ার পরেও মমতা বিপুল ভোটে জিতে এসেছেন। কারণ ভোটারেরা ভুল করেনি। তারা জানতো নিজেকে বাচাতে হলে, কেন মমতাকেই রক্ষা করতে হবে। এই বিজয়ের তাতপর্য সুদুরপ্রসারী। হিন্দুতেবাদের বিজয় রথ থামিয়ে দিতে পারাটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। এটা যেন সেই ইতিহাসের পুনরাভিনয় যখন উত্তর ভারত থেকে আর্য আক্রমণ বাংলায় এসে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলো। বাংলাকে আর্যরা পরাজিত করতে পারেনি। এই অনার্য দ্রাবিড় আর তামাটে জাতির কাছে আর্যদের পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়েছে।

ভারতের মিশ্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বাংলার “হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল”। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের এই বাংলা সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে যে আলাদা তার আরো একটা পরীক্ষা হয় গেল! মোদির পরাজয় শুরু হলো পশ্চিমবঙ্গ থেকে। ভারতকে যে হিন্দুত্ববাদের আঠা দিয়ে জুড়তে চেয়েছিলো বিজেপি সেই তত্ত্ব পরাজিত হলো।

ভারতের রাজনীতির সবচেয়ে দুর্বল অংশ হচ্ছে পুরো দেশকে জুড়তে পারে এমন কোন আঠা নাই। অখণ্ড পাকিস্তানেও ছিলোনা। ইসলামিজম আর উর্দু ভাষাকে দিয়ে এভাবেই পাকিস্তানকে জুড়তে গেছিলো তারা ফলাফল যা হয়েছে সেই একই ফলাফল অপেক্ষা করছে ভারতের জন্য হিন্দুত্ব আর হিন্দি ভাষাকে দিয়ে জাতিকে জুড়তে যাওয়ার ফলে। ভারত রাষ্ট্রের ডিস ইন্ট্রিগ্রেশন হয়তো আমাদের জীবদ্দশায় নাও দেখতে পারি। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের ডিজ ইন্ট্রিগ্রেশনের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। মমতার জয় কী বাংলাদেশের জন্য শুভ বার্তা দিচ্ছে? আমার মনে হয় আরো এক টার্ম মমতার ক্ষমতায় থাকার পরে যেটা সহজের মমতা থাকবেনও বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের ইতিবাচক অনেক কিছু করার রাস্তা আমরা দেখতে সক্ষম হব। বরফ গলতে শুরু করবে।

বাঙালির হৃদয়ে অসাম্প্রদায়িক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বসবাস। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাই বাঙালির আজন্ম অবস্থান। বিজেপির ভোট কমেছে চার শতাংশ। নির্বাচনকে নিয়ে বিজেপির এবং মোদির বিপুল বিনিয়োগ, তৃণমুলের নেতাদের সমানে কিনে নেয়া কিছুই কাজে আসেনি। অনেকেই বলেছিলেন এইবারই নাকি মমতার শেষ জেতা।

এরপরে বিজেপি আসবে। আমার মতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদ অগ্রযাত্রার রথ বাংলায় এসে এইবার পরাজিত হয়ে থেমে গেছে। কেন? কী আছে মমতার রাজনীতিতে যে হিন্দুত্ববাদের এই বাড়বাড়ন্ত ঘৃণার রাজনীতিকে থামিয়ে দিতে পারলো? মমতা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়েছে যে একজন মুসলমানও তার মতই সম অধিকারের নাগরিক।

বাংলাদেশেও তত্ত্বের বদলে, চেতনার বদলে, তথাকথিত আদর্শের রাজনীতির বদলে কমনসেন্সের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হোক। ৯২% মুসলিম দেশে সব ধর্মের সাথে সম্প্রীতি বজায় রেখে, জনগনের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করে এমন সরকার আসুক। তাহলে সব ররফই গলতে শুরু করবে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান নাগরিক, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নির্ধারক ভুমিকা রাখবে। আর এটাই এই অঞ্চলের আগামীর রাজনীতি হয়ে উঠবে।

মানবিক অর্থে মানুষের প্রকৃত ধর্ম হলো মনুষ্যত্ব। আর তাই, মানুষ মনে বা অন্তরে ধারণ করবে মানবিকতার সব গুণাবলি। ধর্ম, মহাপুরুষদের সৃষ্টি হলেও, তাতে বিশ্বাস এবং তাকে পুঁজি করে ব্যবসা ও রাজনীতি কিন্তু মোটেও এক বিষয় নয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এক মানসিক অসুস্থতা।

বহুমাত্রিক.কম