ঢাকা : চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসছেন। অনেক বছর পর চীনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন নেতা বাংলাদেশে আসছেন। এটি শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশে দ্বিতীয় সফর। এর আগে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন।
বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা থেকে তিনি ভারতের গোয়ায় যাবেন। ব্রিকস সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য। ব্রিকস ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত একটি অর্থনৈতিক জোট। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতময় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ সমস্যা নিয়ে ব্রিকস সম্মেলনের মূল অধিবেশনের বাইরে ভারতীয় ও চীনা নেতৃত্বের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতে পারে বলে কূটনীতিবিদরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। বর্তমান বিশ্বে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীন যেভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে সক্ষম, বিশ্বের অন্য কোনো দেশের পক্ষে সেই পরিমাণ সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে চীন এত বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানে সক্ষম ছিল না। চীনা নেতারা বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থায় চীনকে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেই চিহ্নিত করতেন।
চীন এখনও একটি উন্নয়নশীল দেশ। তবে উন্নয়নের পথপরিক্রমায় চীন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। চীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। বিগত বছরগুলোতে চীনে দ্রুত হারে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে। চীনের এই বিস্ময়কর উন্নয়ন অনেক পর্যবেক্ষকের চোখে ধাঁধা মনে হয়। প্রশ্ন হল, চীন কী করে এমন বিস্ময়কর উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হল?
১৯৪৯-এর অক্টোবরে চীন বিপ্লব পূর্ণ সাফল্য অর্জন করে। ১ অক্টোবর ১৯৪৯ বেইজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কয়ারে দাঁড়িয়ে চীন বিপ্লবের নেতা মাও জে দং দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘চীন উঠে দাঁড়িয়েছে।’ সেদিন উঠে দাঁড়ানোর পর চীনকে আর কখনও নত হতে হয়নি। বিপ্লব-পূর্ববর্তী চীনা সমাজ ছিল একটি আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। ১৯৩৫-এ জাপানি সাম্রাজ্যবাদীরা চীনের বিরাট ভূখন্ড দখল করে নিয়েছিল।
অধিকৃত এলাকায় জাপানি আগ্রাসনবাদীরা চীনা নাগরিকদের ওপর নৃশংস অত্যাচার ও গণহত্যা চালিয়েছিল। সাংহাইয়ের মতো বাণিজ্যিক শহর ৪টি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজস্ব কর্তৃত্বাধীন এলাকা হিসেবে ভাগ করে নিয়েছিল। চীন বিদেশী প্রভুদের হাতে বহু অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আপসহীন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশটি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের অভিশাপমুক্ত হয়।
চীনে এক ধরনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, যাকে মাও জে দং আমলাতান্ত্রিক পুঁজি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই পুঁজিবাদ ছিল সাম্রাজ্যবাদের মুৎসুদ্দি। চীনে জাতীয় পুঁজিরও কিছু বিকাশ ঘটেছিল, তবে তা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চীনকে হীনবল ও দরিদ্র করে রেখেছিল। সমাজ কাঠামোর এসব প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি নিশ্চিত করেছিল চীন বিপ্লব।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টিও ১২তম দ্বাদশ কংগ্রেসে মাও সেতুং পরবর্তী চীনের নেতা দেং শিয়াও পিং চীনের বিপ্লবী ইতিহাসের একটি পর্যালোচনা তুলে ধরেন। এই কংগ্রেসটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর ১৯৮২। দেং শিয়াও পিং তার ভাষণে বলেন, ১৯৪৫-এ কমরেড মাও জে দংয়ের সভাপতিত্বে সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেস ছিল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসে আগত প্রতিনিধিবৃন্দ এর আগের ২৫ বছরে অর্জিত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সার সংকলন করেন। এর মধ্য দিয়ে একটি সঠিক কর্মসূচি ও রণকৌশল প্রণয়ন সম্ভব হয়। পার্টির অভ্যন্তরে বিদ্যমান ভুল ধারণাগুলো দূর করা সম্ভব হয়।
এভাবে মার্কসবাদ, লেনিনবাদ এবং মাও জে দংয়ের চিন্তাধারার আলোকে উপলব্ধির ঐক্য অর্জন সম্ভব হয়। সপ্তম কংগ্রেসের মধ্য দিয়েই জাতীয় ভিত্তিতে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিজয় অর্জনের ভিত্তিপ্রত্তর স্থাপিত হয়। ১২তম কংগ্রেসে এসে অষ্টম কংগ্রেসের পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেং শিয়াও পিং বলেছেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কীভাবে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ চালিত করবে সে ব্যাপারে গভীরতর উপলব্ধি অর্জন করেছে।
তিনি বলেছেন, এই কংগ্রেসে গৃহীত সঠিক কর্মসূচি সমাজতান্ত্রিক আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে এবং তাদের পার্টি, তাদের সমাজতান্ত্রিক পথ এবং তাদের দেশ ও সব জাতি গোষ্ঠীর সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।
চীনের কর্মকান্ড পরিচালিত হয় চীনের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির আলোকে এবং চীনা জনগণের দ্বারা। স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতা বরাবরই ছিল চীনের অবস্থান এবং ভবিষ্যতেও এ অবস্থান অব্যাহত থাকবে। চীনা জনগণ অন্য দেশ ও জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাকে মূল্যবান মনে করে। কিন্তু তার চেয়েও মূল্যবান মনে করে তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অধিকারকে। কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের ভাবা সঠিক নয় যে, চীন কখনও তাদের করদ রাজ্য হবে।
অন্যদিকে চীন কখনও তার জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কিছু মেনে নেবে না। চীন একাগ্রচিত্তে বহির্বিশ্বের সঙ্গে মুক্তদ্বার নীতি অনুসরণ করবে এবং সক্রিয়ভাবে বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক উপযোগিতার ভিত্তিতে লেনদেন ও বিনিময় করবে।
দেং শিয়াও পিং আরও বলেন, তারা তাদের মগজ পরিষ্কার রাখবেন, দৃঢ়তার সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু আদর্শের দূষণ মোকাবেলা করবে এবং কখনোই চীনে বুর্জোয়া জীবনযাত্রা ছড়িয়ে পড়তে দেবেন না।
বর্তমান চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে চীনকে একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। তিনি চীনা স্বপ্নের কথাও বলেছেন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চীনা নেতারা জ্ঞান সাধনা ও জ্ঞান সাধকদের ওপর প্রভূত গুরুত্ব দিয়েছেন।
জ্ঞান অর্জনের জন্য হাজার হাজার চীনা ছাত্রছাত্রীকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দেশে ফিরে এসে মাতৃভূমির সেবায় আÍনিয়োগ করেছে। আবার কেউ কেউ বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও বিদেশী গবেষণাগারে গবেষণায় নিয়োজিত হয়েছে। শি জিনপিং চীনা স্কলারদের বিদেশে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি নেই বলে তার এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন।
বর্তমান বিশ্বায়িত বিশ্বে কে কোথায় অবস্থান করল সেটি বড় বিষয় নয়। যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ছোট হয়ে আসা এই পৃথিবীতে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত যে কোনো জ্ঞানপিপাসু যে কোনো স্থান থেকে নিজ দেশের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখতে পারেন। এদিক থেকে চীনা নেতারা একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
চীনে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে বলে উদ্বেগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দেং শিয়াও পিং বলেছেন, ‘গ্রামে ও শহরে কিছু মানুষকে অন্যদের আগে ধনী হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। মানুষ তার কঠোর পরিশ্রম দিয়ে সমৃদ্ধ হবে, এটাই ন্যায্য কথা। কিছু জনগোষ্ঠী এবং কিছু অঞ্চল প্রথমে সমৃদ্ধ হবে- এই উন্নয়ন হবে সবার সমর্থনে। এই নতুন পথ পুরাতন পথের চেয়ে উত্তম।’
চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্র এ রকম জটিলতা ও আঁকাবাঁকা পথের কথাই বলছে। আমাকে একজন চীনা পণ্ডিত বলেছিলেন, চীনে সমতা অর্জনের হাজার পথ তাদের জানা আছে, কিন্তু সমৃদ্ধি অর্জনের পথ খুব একটা জানা নেই। সমাজতন্ত্র দারিদ্র্যের বণ্টন নয়, পুঁজিপতিদের এই গ্লানিকর মন্তব্য ভুল প্রমাণ করার পথেই এগোচ্ছে চীন। এমন একটি দেশের অভিজ্ঞতা আমাদের উন্নয়ন যাত্রায় খুব কাজে আসতে পারে।
চীনের প্রেসিডেন্ট মান্যবর শি জিনপিংয়ের আশু বাংলাদেশ সফরকে `একটি মাইলফলক` আখ্যা দিয়েছেন চীনা পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী প্রতিমন্ত্রী কং জুয়ানিউ। চীনারা যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সফরটিকে দেখতে চান, তাহলে আমার মনে হয় বাংলাদেশের তরফ থেকেও সফরটিকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা যেতে পারে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরকে কতটুকু ফলপ্রসূ করে তোলা যায়, তার কিন্তু অনেকটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ওপর। বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অনুধাবন করতে হবে, এটা সবসময় নির্ভর করে দেওয়া ও নেওয়ার ওপর। পৃথিবীর কোনো দেশেরই বৈদেশিক সম্পর্ক শুধু নীতিনৈতিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা হয় না বা সচল থাকে না। আমরা পছন্দ করি বা না করি, সেখানে থাকে নিজ নিজ স্বার্থচিন্তা। চীনের কাছ থেকেও আমরা যা প্রত্যাশা করি, তা বহুলাংশে নির্ভর করে আমরা চীনকে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কতটুকু দিতে পারব। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এটাই নিরেট বাস্তবতা।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা সঙ্গত হবে যে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি গভীর বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছার সম্পর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিক দিক থেকে সেটা অন্তত দুই হাজার বছরের পুরনো বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল, তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ঢাকা সফরে এসেছিলেন।
পাকিস্তান আমলে আসলে চীন আমাদের এখানে নানা কারণেই বেশ প্রাসঙ্গিক ছিল। ১৯৬৫ সালে ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় চীন সরকার থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে, যদি বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আক্রান্ত হয়, তাহলে চীন আক্রান্তের পাশে সক্রিয়ভাবে এসে দাঁড়াবে। তখনকার প্রেক্ষাপটে চীনের এমন আশ্বাস, এখানকার জনসাধারণের মধ্যে বেশ সাহস জুগিয়েছিল।
একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সম্ভবত ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় চীন পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অবশ্য তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি।
চীনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। বাংলাদেশের সকল সরকারই চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। চীনের দিক থেকেও আগ্রহ ছিল ব্যাপক। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়াও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা সূচিত হয়। মনে রাখতে হবে, পরবর্তীকালে সব সরকারের সময়ই বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা কেবল অব্যাহত থাকেনি, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই চীনের সম্পর্ক সবসময় সহৃদয়। চীনকে বাংলাদেশ সবসময়ই অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে গণ্য করেছে। বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের মধ্য দিয়েও আমরা লক্ষ্য করি, উভয় দেশের এই সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।
মান্যবর শি জিনপিং শুধু চীনের প্রেসিডেন্ট নন, তাকে মনে করা হয় চীনের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। তিনি অনেকটা তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে ক্ষমতার শীর্ষস্থানে উঠে এসেছেন। পার্টি ও জনসাধারণের মধ্যেও তিনি তুমুল জনপ্রিয়। এর আগেও তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তখনও দুই দেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে কয়েকটি বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। আবারও তিনি আসছেন সেই ঐতিহাসিক সুসম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, চীনও সহযোগিতা প্রদানে ইচ্ছুক তাদের নিজস্ব স্বার্থচিন্তা থেকে। কিন্তু আমরা দেখছি, চীনের বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতা ক্রমেই বেড়ে চলছে। তার মানে, উভয় দেশেরই স্বার্থ অভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমে বেড়েই চলছে।
একটি হিসাবে দেখা গেছে, ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীন সরকার বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিয়েছিল। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০০ মিলিয়ন ডলারে। আর আগামী পাঁচ বছরে সেটা পৌঁছবে ২৩ বিলিয়ন ডলারে। এটা বাংলাদেশের জন্য সুখবরই। কারণ চীনের সহযোগিতার প্রকৃতি অন্যান্য অনেক বৈদেশিক দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার চেয়ে অধিকতর কাম্য।
চীনের ঋণ প্রত্যর্পণের শর্ত অপেক্ষাকৃত সহজ। বর্তমানের বৈদেশিক সহযোগিতার শতকরা ৩৬ ভাগ অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। শতকরা ৮ ভাগের কোনো সুদ থাকে না এবং বাকি ৫৬ ভাগও থাকে সহজ শর্তে।
বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশ তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিতে বেশি আগ্রহী থাকে মূলত সহজ শর্তের কারণেই। আমরা দেখেছি, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে শ্রীলংকা অবকাঠামোগত উন্নয়নে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে কোরিয়ার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। একই অভিজ্ঞতা যেন চীনের সঙ্গে না হয়।
মনে রাখতে হবে, চীন আমাদের বহুদিনের পরীক্ষিত বন্ধু। আর অবকাঠামোগত প্রকল্পের বাইরেও শিল্প উৎপাদন ও রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে চীনের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা সম্প্রসারিত হতে পারে। কারণ দেশটিতে শ্রমমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক শিল্প তারা তুলনামূলক কম শ্রমমূল্যের দেশে স্থানান্তর করতে চায়। সেদিক থেকে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে `ব্যালেন্স অব পেমেন্ট` চীনের অনেক অনুকূলে, স্বীকার করতে হবে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, চীন আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য সহজতর করতে ইচ্ছুক। এটাও মনে রাখতে হবে, আমাদের রফতানি অনেক পণ্যের কাঁচামাল চীন থেকেই সহজে আমদানি করা যায়। চীন বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। তবু আমরা চাইব, তৈরি পোশাকসহ সব পণ্যই চীনে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে `জিরো ট্যারিফ` হোক। তা না হলে চীনের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা সহজে দূর করা যাবে না।
চীনের দিক থেকে আগ্রহ ও দক্ষতা রয়েছে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসম্পদ আহরণে। আমরা এ কাজে চীনের সহযোগিতা নিতে পারি। এমনকি চীনে বাংলাদেশি শ্রমশক্তি রফতানির বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা যেতে পারে। বস্তুত চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হতে পারে বহুমাত্রিক। আমরা এতদিন কেবল অবকাঠামোগত প্রকল্পেই তাদের কথা বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। অন্যান্য ক্ষেত্রেও চীনের ভূমিকা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচকই হবে।
পরিরিশেষে বলতে চাই, আমরা দেখতে পাচ্ছিথ উন্নয়ন সহযোগিতা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ তিন দিক থেকেই চীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও চীনের বন্ধুত্ব বাংলাদেশের জন্য বিশেষ কাম্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সব সরকারেরই এ ব্যাপারে উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু সেটা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
চীনের সরকার ছাড়াও জনগণের দিক থেকে যে এ ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। চীন প্রত্যেক পর্যায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে আগ্রহী। আমাদের উচিত হবে, চীনের এই আগ্রহ বিশেষভাবে উপলব্ধি করা ও সম্যক সাড়া দেওয়া।
লেখক :মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ।
বহুমাত্রিক.কম