Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রাম হতে পারে গতিময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইঞ্জিন

ড. আতিউর রহমান

প্রকাশিত: ১৭:৫১, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১৭:৫৯, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রিন্ট:

চট্টগ্রাম হতে পারে গতিময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইঞ্জিন

সেমিনার সভাপতির বক্তব্য রাখছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। ছবি: বহুমাত্রিক.কম

বৈশ্বিক বাণিজ্যের হাব হয়ে ওঠার যে অমিত সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে, তা সবারই জানা। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যে আমাদের এ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সংযোগের গুরুত্বটিও সহজে অনুমেয়। এর পাশাপাশি আশপাশের অন্যান্য দেশও এই সংযোগের উপকারভোগী হতে পারে। এভাবেই উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্যিক কানেক্টিভিটির এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। কেননা ভারত কেবল বাংলাদেশের বৃহত্তম নিকটতম প্রতিবেশী দেশই নয়, গোটা বিশ্বেই একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি।

তবে এর মধ্যেও বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্য তথা ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সংযোগ জোরদার করার বিষয়টি। আর এ ক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই আসে চট্টগ্রামের বিদ্যমান ও নির্মাণাধীন বন্দর এবং অন্যান্য সংযোগ অবকাঠামোর প্রসঙ্গটি। গত ২৬ আগস্ট এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আয়োজিত ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও কানেক্টিভিটি : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করার সুযোগ হয়েছিল আমার। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ এবং গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয়। সম্মানীয় অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।

আলোচনায় অংশ নেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, গবেষকদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি এবং অসরকারি অংশীজনরা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় চেম্বার নেতাদের অংশগ্রহণের ফলে এ অনুষ্ঠানটি হয়ে ওঠে খুবই প্রাসঙ্গিক এবং প্রাণবন্ত। অংশগ্রহণমূলক এই সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চট্টগ্রামকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন, বিস্তার ও সক্ষমতা বাড়ানোর যেসব উদ্যোগ হালে নেওয়া হয়েছে (মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও বে-টার্মিনাল নির্মাণসহ), তাতে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব যে আরও বাড়তে যাচ্ছে- এ কথা সবার আলোচনাতেই উঠে আসে।

আমরা সব সময়ই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে আসছি। আর এ ক্ষেত্রে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে পুরো দেশের এবং প্রতিবেশী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগ বৃদ্ধির বিষয়টিও সামনে আনতে সচেষ্ট থেকেছি। এই সেমিনারেও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। আমাদের সঙ্গে পূর্ণ সম্মতি জানিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাও বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম এগিয়ে গেলে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে।’ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংযোগ বাড়াতে মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি প্রসারের ওপরও জোর দেন তিনি। দীর্ঘকাল ধরে সবচেয়ে কম সংযুক্ত অঞ্চলগুলোর অন্যতম হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার যে পরিচিতি রয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সংযোগ প্রত্যাশিত মাত্রায় বৃদ্ধির মাধ্যমে সে ঘাটতি বহুলাংশে কমানো সম্ভব বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তা ছাড়া দুই দেশের সংযোগ বাড়াতে রেল, স্থলবন্দর ও নদীবন্দরসহ যেসব অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলমান-সেসবেরও সর্বশেষ পরিস্থিতি তিনি তুলে ধরেন।

এই আলোচনায় আলাদাভাবে উঠে এসেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সংযোগ বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামের ভূমিকার কথা। অস্বীকার করার উপায় নেই-ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের যে রপ্তানি সক্ষমতা রয়েছে, তা বহুলাংশে অবাস্তবায়িত থেকে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারতের মোট রপ্তানির ১ শতাংশেরও কম হয় এই সাত রাজ্য থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের অন্তত চারটি স্থলবন্দর (তামাবিল, শেওলা, আখাউড়া ও বিবিরবাজার) দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক হাবগুলো সরাসরি চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক হাবগুলোর নিকটতম সমুদ্রবন্দর হলো চট্টগ্রাম। কাজেই ‘সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা বাস্তবে রূপায়ণের জন্য চট্টগ্রাম প্রকৃত অর্থেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আসলেই চট্টগ্রাম হতে পারে এই রূপান্তরের ‘মিডওয়াইফ’।

বাংলাদেশের জন্য বন্দরনগরী চট্টগ্রামের গুরুত্ব নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও এখনো বাংলাদেশে আমাদনির ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ এবং রপ্তানির ৮৫ শতাংশ হয়ে থাকে চট্টগ্রামের বন্দর দিয়েই। চট্টগ্রাম হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সংযোগ বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা তার দিল্লি সফরে বঙ্গোপসাগর হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত পর্যন্ত একটি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালু চেইন’ দাঁড় করানোকে পুরো এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি বিকাশের জন্য দরকারি বলে অভিহিত করেছেন এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। নিশ্চয়ই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য প্রসারে চট্টগ্রাম হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে। চট্টগ্রামেরই আরেক সহযোগী কক্সবাজার এরই মধ্যে সম্প্রসারিত আধুনিক বিমানবন্দরসহ এই অঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্রিক এক সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক সংযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে যাচ্ছে।

এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলসংযোগ এ সম্ভাবনাকে নতুন গতি দিতে যাচ্ছে। তবে চট্টগ্রামের এ অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বেশি করে বিশেষ নীতি-মনোযোগ দরকার। বর্তমানে ৯ মিটারের বেশি ড্রাফটসম্পন্ন জাহাজ এই বন্দরে ভিড়তে পারে না। ফলে বড় জাহাজ বন্দর থেকে দূরে রেখে সেখান থেকে ছোট আকারের জাহাজে করে বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করতে হয়। এতে বাণিজ্য ব্যয় বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। আশার কথা, এ সংকট সমাধানে ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে বৃহদাকার ‘বে-টার্মিনাল’ নির্মাণ করা হচ্ছে। এই বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের কাজ যত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে করা যায়, ততই মঙ্গল। একই কথা খাটে চট্টগ্রামেই মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের ক্ষেত্রেও। এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি ২০২৬ সালে চালু করা গেলে বাংলাদেশের জিডিপিতে বাড়তি ১ দশমিক ১৪ শতাংশ যুক্ত হবে এবং ৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হবে। একই সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।

চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বন্দরটির উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, এক্সপ্রেসওয়ে ও রিং রোড নির্মাণসহ বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সহায়ক হবে। তবে মনে রাখতে হবে, বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি হলেও যথেষ্ট নয়। এগুলোর পুরো সুফল পেতে যথাযথ ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজও নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু টানেলের কথা বলা যায়। টানেলে ৪টি লেন থাকলেও এখান থেকে বের হয়ে ছোট-বড় গাড়িগুলোকে উঠতে হবে ২ লেনের সড়কে। ফলে সেখানে যানজটের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। তাই এ টানেলের সঙ্গে যুক্ত সড়কগুলোকে ৪ লেনে উন্নীত করার কাজটি যত দ্রুত করা যাবে, তত দ্রুতই এ টানেলের পূর্ণ সুফল আমরা পেতে শুরু করব। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে এলিভেটেড ‘এক্সপ্রেসওয়ে’টি সমাপ্তির পথে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে এটি সম্পন্ন করতে সময় লাগছে। সত্যি বলতে কী, পুরো চট্টগ্রাম মহানগরীকেই ঢেলে সাজানোর দরকার রয়েছে। আগামী দশকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হাব হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলা গেলেই কেবল এটি প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ হয়ে উঠবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে একযোগে কাজ করতে হবে সুসমন্বয়ের ভিত্তিতে।

বাণিজ্যিক হাব হিসেবে চট্টগ্রামের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির দিকেও নজর দিতে হবে সমানভাবে। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যকে বেগবান করতে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট, সর্বাধুনিক কাস্টমস সফটওয়্যার, পণ্যবাহী যানবাহনের ডিজিটাল ট্র্যাকিংয়ের মতো প্রযুক্তিগুলোয় আমাদের বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতোমধ্যেই এ ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে যুগপৎ কাজ করে নয়া প্রযুক্তিগুলোর সুফল আমরাও পেতে পারি। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যে সহযোগিতার মনোভাব বিরাজ করছে, তার সুবাদে এ পারস্পরিক সহযোগিতানির্ভর উদ্যোগ নেওয়া খুবই সম্ভব।

বাংলাদশের সামনে আগামী দশকে যে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে, তা বাস্তবায়ন নির্ভর করছে তিন ‘টি’ তথা ট্রেড, ট্রান্সপোর্ট ও ট্যুরিজমের ওপর। এ তিন দিক থেকেই (অর্থাৎ সমুদ্রবন্দরনির্ভর আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র, সড়ক-রেল-জলপথে পণ্য পরিবহনের হাব ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে) চট্টগ্রাম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য (বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য) সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে সামনের দিনগুলোয় পারস্পরিক মতবিনিময়ের ভিত্তিতে সব অংশীজনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আর তা করা গেলেই চট্টগ্রাম হতে পারবে আরও গতিময় বাংলাদেশের বড় অর্থনৈতিক ইঞ্জিন।

ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer