
আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) বাঙলা কবিতার অন্যতম কারিগর। বাংলার আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-তারা-নক্ষত্র, গাছ-পালা, নদী-নালা, বিল-মাঠ তথা গোটা প্রকৃতি তার কবিতায় এমনভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, এ বৈশিষ্টের দিক থেকে অন্য কোন বাঙালি কবির কবিতায় পরিলক্ষিত হয় না। তার কবিতায় কোনো না কোনো ভাবে প্রকৃতির উপস্থিতি এক অনন্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। তিনি প্রকৃতি প্রেমের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার কবিতায়।
আহসান হাবীবের হাতে কবিতা যেনো প্রকৃতি থেকে নেয়ে সজীব উপাদান যা আরো জীবন্ত হয়ে আছে। দেখলে মনে হয়, এই মাত্র ভূমিষ্ট হল। গায়ে আতুরে গন্ধ। মা যেমন হাসি মুখে সন্তানকে বুকে তুলে নেয় তার কবিতায় প্রকৃতি অনুরূপভাবে আমাদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। সহজ সরল পরিচিত শব্দের এই কারিগর কত মধুর করে প্রকৃতিকে উপস্থাপন করেছেন। তা যেমন হৃদয়স্পর্শী আবেগি তার চেয়েও বাস্তব বেশি। ছন্দ গড়ার কারিগরের ছন্দ যেন প্রকৃতিরই ছন্দ। এই ছন্দ তার কবিতার অন্যান্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পরিচায়ক।
বাংলার প্রকৃতি অঙ্কনে এই কবি নিরলসভাবে লিখেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণী চোখ সব সময় প্রকৃতিতে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। তা না হলে তিনি প্রকৃতির এমন সরস ছবি আকতে পারতে না। প্রকৃতিপ্রেমী আহসান হাবীবের কবিতায় তার প্রমাণ পাওয়া কষ্ঠসাধ্য নয়, বিরলও নয় বরং পঙতিতে পঙতিতে তার প্রমাণ সুস্পষ্ট। তার কবিতা পড়লে বেধোদয় হয়,আমরা প্রকৃতির আদরের চাদরে বড় হচ্ছি।
মায়ের মত আমাদের আঁচল দিয়ে আগলে রেখেছে প্রকৃতি। যা মনে হলে ভালোবাসা জন্মে প্রকৃতির প্রতি। প্রকৃতি ভালবাসতে ইচ্ছে করে। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে যা আমাদের আস্তিত্বও জন্য খুবই প্রয়োজন তা সচেতন মানুষ মাত্রই অনাসে স্বীকার করে। এবং বর্তমান সিসিযেশন নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে। প্রকৃতিপ্রেমী কবির উপস্থাপনা শৈলীতে প্রকৃতির রূপ কিভাবে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তা নিচের আলোচনায় অস্পষ্টÑআধার থাকবে না, সূর্যালোকে দেখা কেনো বস্তুর ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মানুষ নশ্বর। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে চলে যেতে হবে। নিশ্চিত এই যাত্রা সম্পর্কে মানুষ জানে। এটা যেমন চিরন্তন তেমনি মানুষ যেখানে বাস করে যে প্রতিবেশ ও পরিবেশও সময়ে ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়।
কবি বাংলাদেশের যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন-আশৈশব লালিত-পালিত হয়ে সেখানে কার অলি-গলি, প্রকৃতি তার চিরচেনা। এই চিরচেনা প্রকৃতিকে কবি স্বাক্ষী দিতে বলেছেন যে, কবি কোনো আগন্তুক নন। যে প্রকৃতিতে মানুষ বড় হয় সে প্রকৃতির মত আর কেউ সুস্পষ্ট করে বলতে পারে না তার ঠিকানাÑ স্বভাব। প্রকৃতিই উত্তম স্বাক্ষী। এর মত স্বাক্ষী দ্বিতীয়টি হতে পারে না।
কবি এ মাটিতেই জন্মগ্রহণ করে এখানে জীবনযাপন করেছেন। তার এই কথাকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রকৃতিকে অপূর্ব ব্যঞ্জনায় তুলে এনেছেন। ফুল, বাঁশবাগান, জারুল, জামরুল, পুকুর-মাছ, পাখি তথা গোটা প্রকৃতিকে কবি সাক্ষী মেনেছেন। কারণ এই প্রকৃতিতে কবি বসবাস করেছেন। কাজেই প্রকৃতিই সব থেকে ভাল চেনে কবিকে।
আমরা যদি কাউকে জানতে চাই আমাদের আগে জানতে হবে সে যেখানে বসবাস করেছেন তার প্রকৃতি সম্পর্কে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে কবি বলেছেন, আমার চারপাশ, আমার প্রকৃতিকে জিজ্ঞাসা করো আমি কে। তাহলে যথার্থ জানতে পারবে। অন্যথায় জানা ভুল হবে। আমার প্রকৃতিই সবচেয়ে ভাল জানে আমি কে, আমার পরিচয় কি। এই সব প্রশ্নর উত্তর জানতে বাঙলার প্রকৃতিকে স্বাক্ষী মেনে কবি লিখেছেন-“আসমানের তারা সাক্ষী/সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই/নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী/সাক্ষী এই জারুল, জামরুল, সাক্ষী পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পাশে স্থির দৃষ্টি/মাছরাঙা আমাকে চেনে/আমি কোনো অভ্যাগত নই/খোদার কসম, আমি ভিনদেশী পথিক নই/আমি কোনো আগন্তুক নই।” (আমি কোনো আগন্তুক নই)
বাঙালির জীবন সংগ্রামী জীবন। নদীমাতৃক বাঙলাদেশে কপোতাক্ষ, ভৈরব, সোনাই, ময়ূরাক্ষী, কর্ণফুলী নানা নামের তেরশ নদী প্রবাহিত। নদী এক সময় এদেশের প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম ছিল। সে জন্য নদীর তীরে ঘন বসতি গড়ে ওঠে। শুধু যাতায়তের মাধ্যমই নয়, জীবন জীবিকারও অন্যতম মাধ্যম।
বাংলাদেশের অন্যতম বড় নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। পদ্মা নদীর প্রভাবকে কেন্দ্র করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় “পদ্মা নদীর মাঝি” নামক বিখ্যাত বাস্তবসম্মত উপন্যাস লিখেছেন। এছাড়াও বাংলা কবিতার বৃহত্তর জায়গা দখল করে আছে নদী। মেঘনা নদীর পাড়ে জীবন যাত্রা, প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা পাই আহসান হাবীবের কবিতায়।
তিনি লিখেছেন- “পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকো আমার ভাসে/মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে-/মাথার ওপর মুচকি হাসে/বিজলী নামের মেয়ে/আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।/আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা/ঝড়ের সঙ্গে লড়াই ক’রে কাটাই সারাবেলা।” (মেঘনা পাড়ের ছেলে)
সন্ধ্যা রাতে ঝোঁপ ঝাড়ে জোনাকি পোকা আলো দেয়। যা দেখে মনে হয় আকাশের তারাগুলো নিচে নেমে এসেছে। সে আলোতে এক মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে যা খুবই মনোমুগ্ধকর। সেই ছবি মনে অন্যরকম আনন্দ জাগায়। আহসান হাবীব লিখেছেন- “সেই-অন্ধকারে শন শন শন/আওয়াজ শুধু তোলে।/ভয়েতে বুক চেপে/ঝাউয়ের শাখা পাখির পাখা উঠেছে কেঁপে কেঁপে।/তখন-একটি দুটি তিনটি করে এসে/এক শো দুশো তিন শো করে/ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে” (জোনাকিরা)
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এবং মানুষের অসচেতনার জন্য প্রকৃতির অনেক উপাদান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের অস্তিত্বও একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। খর¯্রতো নদী আজ মরা। নদীতে পাল তোলা নৌকা চলে না। জোয়ারে পানি ফুলে উঠে ভয় দেখায় না ছোট ছোট ডিঙি নৌকাকে। নদীর ঘাটে পারাপারের নৌকা নেই। সেই মাঝি নেই যারা নদীকে ভালবেসে নৌকায় দিনরাত কাটিয়ে দিত।নদীতে বড় বড় বাধ উঠছে। পাড় দখল করছে দখলদাররা। নোংরা আবর্জনা ভরে দিচ্ছে নদীর পেট। কিন্তু কবির শৈশবের সেই নদী নিরঞ্জনার কথা মনে পড়ছে। যেখানে মানুষ আসত সূচী স্নান করতে। সে নদী এখন আর নেই! এখন অন্য কোনো নদীর সন্ধান করতে হবে যেখানে এই মানুষগুলো স্নান করে শুদ্ধ হবে। কিন্তু এই মানুষগুলো যা আছে তাই বাঁচাতে সচেতন নয় । সেখানে বিকল্প কিবা করতে পারে।
কবি লিখেছেন- “এইখানে নিরঞ্জনা নদী ছিলো/এই ঘাটে হাজার গৌতম/ স্নান করে শুদ্ধ হয়েছেন।/নদী আছে ঘাট আছে/সেই শুদ্ধ জলের অভাব/অশুদ্ধ মানুষ খুব বেড়ে গেছে। সারিবদ্ধ স্নানার্থী মানুষ/মরা নদী মরা স্রোত ছাড়িয়ে এখন-/বলে দাও/যেতে হবে অন্য কোনো নিরঞ্জনা নদীর সন্ধানে।” (এইখানে নিরঞ্জনা)
প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষের আসল সুখ। যারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে মিশে থাকতে পারে তারা নিঃসন্দেহে সুখী মানুষ। কিন্তু ক’জনই বা প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে পারে? আবার কিছু মানুষ প্রকৃতিকে নষ্ট করার পায়তারা করছে।খোকার প্রশ্ন আজ আমাদের সকলের সেই একই প্রশ্ন। মানুষকে পাখিরা কেন ভালবাসে না ? কেনে পাখিরা কাছে আসে না? কেনে পাখিরা ভালবাসে না আমাদের ? কেনো পাখিরা বিশ্বাস করে না মানুষদের? এই সব প্রশ্ন আমাদের বোধে নাড়া দেয়। প্রকৃতিকে ভালবাসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে আমাদেও সকলকে। কিন্তু মানুষের হিং¯্রতায় প্রকৃতি বিরূপ বিকটরূপ ধারণ করলে আমাদের অস্তিত্ব কোথায় দাঁড়াবে তা আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে প্রকৃতির প্রতি সদয় হওয়া মানে আমরা আমাদের নিজেদের প্রতি সদয় হচ্ছি।
খোকার আগ্রহের মত আমাদের জানতে হবে কি করলে প্রকৃতি ভাল থাকে। পাখিরা কাছে আসে-ভালবাসে। আমাদের ভালবাসতে হবে প্রকৃতিকে। আমাদের প্রকৃতিকে নিজেদের স্বার্থে রক্ষা করতে হবে। তাই আসুন আমরা প্রকৃতির ব্যাপারে যত্নবান হয়। পরিবেশ-প্রকৃতি বাঁচাতে নিজেরা সচেতন হয়। বিভিন্ন সামাজিক আন্দেলন গড়ে তুলি।
আহসান হাবীবের “ঘুমের আগে” কবিতায় মা ও ছেলের কথোপকথনের মাধ্যমে প্রকৃতির ভয়ের কথা তুলে ধরেছেন এভাবে- “জানি, ওরা পাখি কি-না, মানুষকে ভালোই বাসে না।/বলো না মা কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে,/কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।”
বাংলা সাহিত্যে আহসান হাবীব এক প্রকৃতি প্রেমের স্বতন্ত্র পথ আবিষ্কারক। তিনি প্রকৃতিকে ভালোবেসে প্রকৃতিতে বিচরণ করে প্রকৃত সুখ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সহজ কথায় প্রকৃতিক উপাদানের ছন্দোই আহসান হাবীবের কবিতা।প্রকৃতির সাথে আমরা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বাস্তুসংস্থানের মত।
প্রকৃতি রক্ষায় আমাদের আজ বেশি সচেতন হতে হবে। বিশ্বে যে ভাবে শিল্পায়ন-নগরায়ন হচ্ছে তাতে মনে হয় আমাদের প্রকৃতির জন্য তা হুমকিজনক। এভাবে চলতে থাকলে অনেক প্রাণীর মত আমাদের অস্তিত্বও প্রশ্নের মুখোমুখি হবে।
বিশ্বের নানা জায়গায় প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আসুন আমরা সবুজ প্রকৃতি বাঁচায় নিজেরা বাঁচি।আহসান হাবীব যথার্থই প্রকৃতিকে ভালবেসে ছিলেন। এজন্য প্রকৃতির প্রতি তিনি দরদী ছিলেন। এই সংকেত প্রদানকারী রাডার কবির মত আমরাও প্রকৃতিকে ভালবাসি-দরদী হই। প্রকৃতি রক্ষায় আমরাও কার্যকর ভূমিকা রাখি।
কারুকাজ, কেশবলাল রোড, যশোর
বহুমাত্রিক.কম