![হোচট খাওয়া জীবনে ক্যারিয়ার গড়ার গল্প হোচট খাওয়া জীবনে ক্যারিয়ার গড়ার গল্প](https://www.bahumatrik.com/media/imgAll/2018September/career20200927204842.jpg)
১৪ বছরে যখন আমার বিয়ে হয় তখন দুনিয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এক বাচ্চা মেয়ে ছিলাম। ক্যারিয়ার বলে কোন শব্দের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। বাসা-স্কুল, স্কুল-বাসা এই ছিল বেরোনোর গন্ডি। আব্বার সাথে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আব্বা সব জায়গায় আমাকে নিতেন। কিন্তু তাতে তো আর দুনিয়া চেনা যায়না।
বড় দুই মেয়ের জন্মের পর টাকার প্রয়োজন একটু করে বুঝতে শুরু করলাম। তবে সে বুঝ অতটা প্রকট ছিলনা। ছোট মেয়ের জন্মের পর আস্তে আস্তে ইচ্ছে টা কেবল বাড়তে থাকল। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই আবার গ্রামে থাকি। তার উপর আমার শ্বশুর বাড়িতে মেয়েদের সেভাবে কেউ কখনো ভাবেও নি। মেয়েরা রান্না করবে, বাচ্চা পালবে, স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সেবা করবে। এই তো জীবন! এদের আবার টাকার কি দরকার?
কিন্তু আমার তো দরকার। প্রথম প্রথম বাড়ির বাঁশ, সুপারি, নারিকেল বিক্রির কিছু টাকা নিয়ে হাতখরচা হত। একসময় সেটা আর হচ্ছিল না। কারণ আমার শ্বাশুড়ির জন্য এগুলো ইনকামের সোর্স ছিল। মুরগী পালতে চাইলাম। কিন্তু দিনদুপুরে শেয়ালের খাদ্য হয়ে বিকেলবেলা মুরগির দেখাও মিলত না।
২০০৬ চলে এলাম সিলেট শহরে। ইচ্ছে টা অব্যাহত থাকলো। ১ম চেষ্টা ছিল কাপড় এ ফেব্রিকস পেইন্ট এর কাজ। মার্কেটিং এর ব্যপারটা কাউকে দিয়ে করাতে পারলাম না। আমার তো ঘর থেকে বেরোনো নিষেধ। তারপর আবারও চেষ্টা। আবার মুরগী পালন করলাম। মুলধন আমার বড় ভাশুর দিলেন। ভালোয় ভালোয় ৫ মাস গেল। পরে শেয়াল এটাও তছনছ করে দিল। মনটা একবারে খারাপ হয়ে গেল। আমাকে দিয়ে হবে না।
২০০৯ আবার চেষ্টা। এবার বিছানার চাদর এ নিজ হাতে এপ্লিক এর কাজ করলাম। ৩টি বিক্রিও করলাম। কিন্তু আবারও সেইম সিচুয়েশন! মার্কেটিং এর ব্যাপারে আবারও ধরা খেলাম। কারণ আমার হাজব্যান্ড মার্কেটিং এর ব্যাপার টা গুরুত্ব দিতেন না।
এবার আমার আব্বার কাছ থেকে ১৬,০০০ টাকা মুলধন নিলাম। কেক বানানোর যাবতীয় সরঞ্জাম কিনে কেক বানাতে শুরু। আবার ফ্লপ। এবার আমার স্বামীকে অনেক কষ্টে রাজি করলাম। শুরু করলাম সমুচা, রোল, মোগলাই পরোটা, অনথন এর ব্যবসা। এক বছর সফল ব্যবসা করলাম। কিন্তু লোকে নানান কথা বলে বিধায় আমার উনি আর এই ব্যবসা চালু রাখতে চাইলেন না। আবার বন্ধ।
এবার মেয়েদের স্কুলে শর্মা, রোল, সমুচা সাপ্লাই দিলাম টিফিন হিসেবে। সেটাও জামেয়ার প্রিন্সিপাল সাহেব আপত্তি করলেন। কতদিন আবার আফসোস নিয়ে বসে থাকলাম। ছ্যাছড়ার মত আবার নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ছোট ভাইয়ের বউকে দিয়ে আনরেডি থ্রি পিস আর বিছানার চাদর আনালাম। স্কুলে এক শিক্ষকের সাহায্য কামনা করলাম। উনার কাছে তিন মেয়ে কোচিং করত। সেই দাবি নিয়ে আবার গেলাম। উনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেল হল না।
হায়! আমি বোধহয় আর পারব ও না। শেষ চেষ্টা! এ সময় সংসারের অবস্থা ও খারাপ। এবার আর শখ নয়। এবার প্রয়োজন। প্রথম চেষ্টা করলাম কওমী মাদ্রাসায়। যদি আমাকে ওরা কোনভাবে নেয়। কারণ মুয়াল্লিমা ট্রেনিং আমার আব্বা ক্লাস এইট-এ থাকতে করিয়েছিলেন। শ্বশুর বাড়িতে মাদ্রাসা পড়া পড়লেও পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তাই সার্টিফিকেট ছিলনা। হলনা কোথাও। তখন উনিও চাইতেন আমি কিছু করি। লিফলেট ছাপালাম। ওয়ান থেকে এইট পর্যন্ত বাচ্চাদের পড়াতে চাই। সাথে কুরআন শিক্ষা। আমার মেয়েদের শিক্ষককে দিয়ে স্কুলে বিলি করালাম। কুরআন পড়তে কেউ আসেনি। কিন্তু সেই প্রথম ওয়ান থেকে এইট কিছু ছাত্রী পেয়ে গেলাম। সাল টা ২০১২ হবে। পড়ানো শুরু।
কিন্তু এতেও প্রবলেম ছিল। এত অল্প আয় ছিল যে তাতে আমার কিচ্ছু হত না। ভাবলাম অভিজ্ঞতা হবে, চালিয়ে যাই। এভাবে কেটে গেল ৫ বছর। একসময় আমার স্বামীর ব্যবসা প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হল। এবার সময়ের প্রয়োজনে হাল ধরতেই হল। এগিয়ে এলেন আমার বড় জা আমার বোন-মা, বন্ধু হয়ে। আমি চিরকৃতজ্ঞ ওনার কাছে। ইয়াসমিন কিবরিয়া আমার বিপদের দিনে ফেরেশতার মত এগিয়ে এলেন। উনি আমেরিকা থাকেন। সেখানে সবাইকে আমার কথা বলতে শুরু করলেন। আমি কুরআন পড়াই। যা বলার উনি বাকি রাখেন নি। আল্লাহ উনাকে অনেক ভাল রাখুন।
২০১৬, সেপ্টেম্বর মাস। প্রথম স্টুডেন্ট ভাবির বোনের ছেলের মেয়েকে দিয়ে শুরু হল অনলাইন কুরআন টিচিং। সেই থেকে আরেক দিকে জীবন মোড় নিল। আজ আলহামদুলিল্লাহ ১৫/১৬ জন স্টুডেন্ট। এর মধ্যে আমার ছোট জা এর কাছে একটা কোর্স করছি। ইযাজা কোর্স। কিভাবে কি হল আমি আজ ভেবে শুকরিয়া আদায় করি আল্লাহর দরবারে। এখন এটাই আমার ক্যারিয়ার। আমার সবকিছু। আল্লাহপাক এই খেদমতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লাগিয়ে রাখেন এই চাওয়া।
বহুমাত্রিক.কম