
ছবি- বহুমাত্রিক.কম
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গত কয়েক মাসে দুইশতাধিকেরও বেশি মূল্যবান গাছ চুরি হয়েছে। তবে বন্যপ্রাণী বিভাগের তথ্যমতে একবছরে ১৬১ টি গাছ চুরি হয়। রেঞ্জ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে গাছ চুরির অভিযোগ উঠলেও তাতে কোন তোয়াক্কা করেননি তিনি। ফলে বনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। বন কর্মকর্তার দায়িত্বহীন বক্তব্যসহ গাছ চুরির সংবাদ প্রকাশের পর লাউয়াছড়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শুরু হয়েছে তদন্ত কার্যক্রম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে দীর্ঘ সময় ধরেই মূল্যবান প্রজাতির গাছ চুরির ঘটনা ঘটছে। একটি সিন্ডিকেট চক্র রাতের আঁধারে এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে তারা বনের টিলা থেকে আকাশমনি, চাপালিশ, আগর, মেহগনি, চিকরাশিসহ নানা প্রজাতির মূল্যবান ও পুরানো এসব গাছ কেটে খন্ডাংশ করে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরেই এমন অভিযোগ থাকলেও বিষয়টি ছিল ধরাছোয়ার বাইরে।
এই সময়ের মধ্যে লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির পেছনে আগর বাগান, বাঘমারা ক্যাম্পের সম্মুখে ও মুজিবের উঠনি টিলার কিছু অংশে কেটে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু গাছ। কালের স্বাক্ষী হিসাবে পড়ে রয়েছে এসব গাছের গোড়া। বাঘমারা বন ক্যাম্প সংলগ্ন মন্ত্রিরটিলা থেকে সম্প্রতি মেহগনি ও চিকরাশি প্রজাতির ছয়টি গাছ চুরি হয়েছে। সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে এসব গাছের গুড়ি।
এছাড়াও কালাছড়া বিট থেকে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী বেশ কিছু গাছ চুরি হয়েছে। এসব বিষয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা কাউকে তোয়াক্কা করেননি। নিজের ইচ্ছেমতোই বন টহল দলের কতিপয় সদস্যদের মাধ্যমে আভ্যন্তরিন কার্যক্রম চালিয়েছেন। এভাবে গত কয়েক মাসে প্রায় দু’শতাধিক গাছ চুরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট তথ্যে জানা যায়। এসব বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষ রোববার রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেনকে প্রত্যাহার করেন।
গাছ চুরির এসব অভিযোগ বিষয়ে সহকারী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী) আনিসুর রহমান তদন্ত শুরু করেছেন।
সিলেট-আখাউড়া রেলপথ, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কপথ ও বিদ্যুত লাইনের ঝুঁকির মাঝে থাকা লাউয়াছড়া উদ্যানের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে রয়েছে। তার উপর গাছ চুরি হওয়ায় বনের মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে।
স্বল্প জনবলের কারণে বনের বিশাল এলাকা দেখভাল করা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে বন্যপ্রাণী বিভাগ দাবি করছে। উদ্যানের লাউয়াছড়া, কালাছড়া ও চাউতলী তিনটি বনবিটের মধ্যে বিট কর্মকর্তাসহ ৩০ জন লোকবলের বিপরীতে আছেন মাত্র ১২ জন লোক। এদের সাথে দেখাশুনায় কিছু কো-ম্যানেজমেন্ট (বন টহল দল) থাকলেও বর্তমানে তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এসব টহল দলের কিছু অসাধু লোকও গাছ চুরির সাথে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে বন্যপ্রাণী বিভাগের তথ্যমতে, গত বছরের মার্চ মাস থেকে ২০২০ সনের মার্চ পর্যন্ত ১৬১টি গাছ চুরি হয়েছে। গাছ চুরি হওয়ায় গত কয়েক মাসে ১৫টি মামলা হয়েছে এবং ৯৭০ ঘনফুট কাঠ উদ্ধার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উদ্যানের দু’জন বন টহল দলের সদস্য (সিপিজি) জানান, রেঞ্জার মোনায়েম হোসেন দীর্ঘ দুই বছর ধরে এখানে আছেন। তার দু’তিনজন গার্ড ও টহল সদস্যদের মাধ্যমে চুর দলের সাথে সম্পৃক্ত করেই রাতের আঁধারে গাছ চুরি হত। পিকআপ, ট্রলি দিয়ে গভীর রাতে গাছের এসব খন্ডাংশ বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়। তারা আরও বলেন, নানা অনিয়মের সাথে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত। বনের রাস্তায় জমা হওয়া সিলিকা বালু পর্যন্ত গোপনে বিক্রি করেছেন। বাঘমারা ক্যাম্পের সম্মুখে ঠিকাদার গোলচত্ত্বর তৈরীর সময়ে তিনি ওই ঠিকাদারের কাছে অবৈধভাবে বালুও বিক্রি করেন। এসব বিষয়ে কিছু বলতে গেলেই তিনি নানা ধণের হুমকি, ধামকি প্রদান করতেন।
অভিযোগ বিষয়ে লাউয়াছড়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন মোবাইল রিসিভ করেননি। তবে এক সপ্তাহ পূর্বে তিনি ফোনে বলেন, “বন যতদিন থাকবে, ততদিন গাছ চুরি হবে। স্বল্প এই জনবল দিয়ে ১২৫০ হেক্টরের লাউয়াছড়া বিশাল বন রক্ষা করা খুবই কঠিন।” বনের বালু বিক্রি বিষয়ে তিনি বলেন, এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও আপনারা ধরছেন।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় সহকারী বন কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, তদন্ত করে দেখছেন আরও গাছ চুরি হয়েছে কি না।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ঢাকাস্থ উর্দ্বতন অফিস থেকে লাউয়াছড়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেনের বদলির আদেশ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সংবাদ মাধ্যমে যে ১৭১টি গাছ চুরির কথা বলা হয়েছে তা গত এক বছরেরও বেশি সময়ে এগুলো হয়েছে। করোনাকালীন ও সম্প্রতি সময়ে বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া এভাবে গাছ চুরির সংবাদ পাওয়া যায়নি।
বহুমাত্রিক.কম