Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘লকডাউন‌’ কেন প্রয়োজন

ফারদিন ফেরদৌস

প্রকাশিত: ১৩:৫৭, ১২ এপ্রিল ২০২০

প্রিন্ট:

‘লকডাউন‌’ কেন প্রয়োজন

-লেখক

এটা বড় সত্য, কোনো প্রাণ মরণ এড়াতে পারবে না। শ্যামসমান মরণ আছে বলেই হয়ত জীবন এত সুন্দর, মায়াবী ও আনন্দময়। বিশ্বাস করুন, চলমান করোনা মহামারীকালে ‘লকডাউন’ ভাঙা মানে সেই জীবন নিয়ে অকাল খেলা। ঘরে থাকবার গুরুত্ব অনুধাব এজন্যই জরুরি। হেলাফেলাকারীদেরকে করোনাভাইরাস করুণা করে এখনো এমন নজির দেখা যায় নাই।

ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এখন মহাশ্মশান। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান, রাজপুত্র/কন্যা আক্রান্তের তালিকা থেকে কেউ বাদ যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও চোখের সামনে এই ভয়াল ট্রাজেডি না নিতে পেরে অবসাদে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে।

থমাস শেফার। জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী। করোনাকালের পর বিশ্ব অর্থনীতি কী হাল দাঁড়াবে এবং এর প্রভাবে মানুষের জীবন কী এক মর্মন্তুদ অবস্থায় নিপতিত হবে -এই দুঃশ্চিন্তায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন। রেললাইনের ওপর তাঁর মরদেহ পাওয়া গেছে।

এমন বাস্তবতায় কী হতে পারে আমাদের অদূর ভবিষ্যত? আমাদের কপালে একবেলা খাবারও জুটবে তো? শিশুদের মুখে পবিত্র হাসি ধরে রাখতে পারব তো? বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করা এবং হাসি-তাচ্ছিল্যে সবকিছু উড়িয়ে দেয়া বোকার স্বর্গে বাস করারই সমান।

বিশ্বের টালমাটাল এই সময়টায় বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, গবেষণা সবই বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন। ভাইরাস মানুষকে একা করে দিচ্ছে, বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। চিরায়ত মানবিক বা সামাজিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করে দিচ্ছে। হয়ত ভয়ঙ্করভাবে ফিরে আসতে চলেছে চরম স্বার্থবাদী তত্ত্ব ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’!

যখন বিজ্ঞানকে বলবেন, দেদারছে মানুষের মড়কের কালে তুমি ওষুধ দাও, পথ দেখাও, সে দিতে পারে না; আবার ঈশ্বরের কাছে জীবন চাইবেন, তিনিও সাড়া দেন না, উপরন্তু নিজের ঘর প্রার্থনালয়ই লকডাউন করে রাখেন; সেই পরিস্থিতিতে কারোরই মাথায় কাজ করার কথা না। এক অতুল নৈরাশ্য বিবেক ও বোধশক্তি গিলে খায়। ভালোবাসা, প্রেম ও জীবনবাদিতা সব মিথ্যে হয়ে যায়।

এখন নাম্বার ওয়ান মৃতপুরী ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে চোখের জলে ভিজে গিয়ে তাই বলে দেন, ‘আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ, ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নাই’। সেই ওপরে কী থাকে? অসীম শূন্যতা নাকি অমিত ক্ষমতাধর খোদা, ভগবান, ঈশ্বর, গড -তা যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণসাপেক্ষে পৃথিবীর ক্ষুদ্র মানুষ এখনো জানে না। এবং ভয়াল এক অস্বাভাবিকতায় পুরো পৃথিবী এখন অচল। সচল শুধু ‘ডিসিজিং কাউন্টিং’!

এত ভয়াবহ সময়। যেখানে যুক্তিবোধ পুরো বিপর্যস্ত। সেসময় মৌলবাদ, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা আরও বেশি জেঁকে বসে। উপায় যখন নাই হতবিহ্বল মানুষ তখন খড়কুটোই আকড়ে ধরে। আতঙ্ক মানুষের যৌক্তিক চিন্তাভাবনা বিলোপ ঘটায়।

সাম্প্রতিক খবরের শিরোনামগুলো দেখেন...

-করোনাকে আল্লাহর শাস্তি বলায় সৌদি আরবে গ্রেপ্তার ৪
-জামাতে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় পাকিস্তানে গ্রেপ্তার ৪৩ ইমাম
-নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে অষ্টমী স্নান বন্ধ রাখবার সিদ্ধান্ত
-সব ধর্মানুসারীকে ঘরে থেকে প্রার্থনা করবার অনুরোধ প্রধানমন্ত্রীর

কিন্তু করোনাভাইরাস এপিডেমিক পর্যায়ে গেলেও বাংলাদেশের মৌলভীদের মসজিদে জামায়াত না আসছে। বিশ্বব্যাপী দ্রুতগতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বার কালে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ২৮টি দেশ থেকে ১০ হাজারের বেশি মার্কিন নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু নাগরিক কাল সোমবার বিশেষ একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন।

এমনিভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের নাগরিকদের অধিকাংশই বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন।তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালো। তাও কেন বিদেশিরা দেশ ছাড়ছেন? তাদের বক্তব্য হলো, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা কেউ বলতে পারে না। বৈশ্বিক লকডাউন আরও বাড়তে পারে। সুতরাং যে যার দেশে অবস্থান করাই সমীচিন মনে করছেন সবাই। এমনকি নিজের দেশের মারাত্মক ভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকি সত্ত্বেও। মরি যদি নিজের দেশেই মরি -ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত হয়ত এমনই।

চীনের মতো করোনা হাসপাতাল বানাচ্ছে আকিজ গ্রুপ। ৫ হাজার শয্যার করোনা হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা বসুন্ধরা গ্রুপের। দেশে এখন প্রায় প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চায়না থেকে আমদানি হচ্ছে পিপিই, টেস্ট কিট ও অন্যান্য সরঞ্জাম। কী মনে হয় এই হাসপাতালগুলোতে ভূতে চিকিৎসা নেবে?

এইটুকু আমরা ভাবতে কি পারি না যে, আমরা যদি সহি সালামতে ম্যাজিক্যালি ভালোই থাকি, প্রতিবেশির বিপদে আমরা সমব্যথী হবো, এগিয়ে যাব। এইসব হাসপাতাল থেকে প্রশিক্ষিত ডাক্তার-নার্সরা অন্যত্র দুর্বিপাকে পড়া মানুষদের সেবায় এগিয়ে যাবেন।  এতসব বিশ্লেষণের পর আমাদের রোগীর হিসাব কম আছে বলেই ফুর্তিতে ট্রল করবার রুচি কারো থাকা উচিৎ? বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে আমাদের মন নিবিষ্ট হবে না?

সরকারি হিসাব যাইহোক। করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতাল থেকে রোগী পালিয়ে যাওয়ার খবর আসছে। বিচ্ছিন্নভাবে সরকারি হিসাবের বাইরে সারাদেশ থেকেই করোনা লক্ষণ নিয়ে মৃত্যুর খবর আসছে। করোনা সন্দেহে সর্দিজ্বরের রোগী দেখেও স্বজন ও ডাক্তাররা পলান্তিক দিচ্ছেন। এমন একটা দেশে নিজের ব্যক্তিগত সতর্কতা ও সচেতনতার ওপরে আর কথা থাকাই উচিত নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ৪ পরামর্শ ও বার্তা দিয়েছেন। তিনি ভাইরাস প্রতিরোধে হাত ধোয়া, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বজায় রাখা এবং বাড়িতে অবস্থান করার কথা বলেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি মুসুল্লিদের এইসময় ঘরে নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশে সুরক্ষা ও চিকিৎসা সংকট নেই বলে জনসাধারণকে আশ্বস্ত করেছেন। আতঙ্কগ্রস্ত ও ভীত না হয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকতে বলেছেন। এবং এইসময় সবাইকে সহনশীল ও সংবেদনশীল হতে বলেছেন।

কী মনে হয়? করোনাভাইরাস নিয়ে এত কথা কেন হচ্ছে? প্রশাসন, পুলিশ, আর্মি সবাই মিলে এত কষ্ট কেন করছে? মানবিক মানুষেরা সমাজের হতদরিদ্র মানুষদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে যাচ্ছে কেন! কখন কী পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় আগাম কেউ জানে না। কাজেই কথা একটাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোভিড-১৯ সতর্কসংকেত যতক্ষণ না তুলে নেয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমি সুবোধ বালক-বালিকার মতো লকডাউনেই থাকবো।

এর ব্যতিচার হওয়া মানে করোনাভাইরাসের সাথে আত্মীয়তা পাতা। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত শিরোধার্য কেন নিশ্চয় এতক্ষণে অনুভব করা গেল। অনন্ত অসীমের আরাধনা চলুক। অদেখা ওপরওয়ালা ছাড়া ভরসা করবার জায়গাও তো বিশ্বজুড়ে এখন আর দেখি না। হয়ত বিপুল বিপর্যয় শেষে নবরূপে পৃথিবী আবার ঘুরে দাঁড়াবে। প্রকৃতি বা ঈশ্বরের অমৃত সন্তানেরা হাত ধরাধরি করে চলবে, হাসবে, খেলবে, গাইবে জীবনবাদী গান।

কবিগুরু রবিঠাকুর মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলেছেন। ‘মরণ’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’। নিজেকে সত্য ও সুন্দরের পথে আমূল বদলে ফেলার পর আর খানিকটা সময় সেই শান্তি ও আনন্দকর অনন্তকে যেন যূথবদ্ধ আমরা জাগিয়ে রাখি।

লেখক: সাংবাদিক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer