ছবি : পিআইডি
ঢাকা : ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা জাতির জন্য বড় আঘাত উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও মহাত্মা গান্ধীসহ দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দানকারীদের ওপর বারবার হিংসাত্মক আক্রমণের কারণ খুঁজে বের করতে গবেষণা হওয়া উচিৎ।’
তিনি মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ আব্দুর রব হলের মাঠে আয়োজিত বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে এ কথা বলেন। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। ব্রহ্মদেশে (মিয়ানমার) অং সান সুচির পিতা জেনারেল অং সান ব্রাশ ফায়ারে নিহত হলেন।
১৯৬০ সালে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী নিহত হলেন। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন তারা নিহত হলেন জেলখানার ভেতরে। পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হলো। এই যে বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক হত্যা এর কারণ কী- এ অঞ্চলের মানুষকে তা জানতে হবে।’
এসব হত্যাকান্ডের কারণ জানতে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। গবেষণার মধ্যদিয়ে এ সত্য জানার আশা প্রকাশ করে প্রণব বলেন, ‘রাস্তা যদি চিনি তাহলে চলা শক্ত হবে না।’
অনুষ্ঠানে ভারতের প্রথম এই বাঙালি রাষ্ট্রপতির হাতে ডি-লিট ডিগ্রির স্মারক তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। এ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, সংসদ সদস্য আশেকউল্লাহ রফিক, সংসদ সদস্য ওয়াসেকা আয়েশা খান, উপ-উপাচার্য শিরিন আখতার, শিক্ষকবৃন্দ ও ছাত্র-ছাত্রীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
প্রণব মুখ্যোপধ্যায় বলেন, ‘আমরা যেমন ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি আততায়ীর গুলিতে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে ভারতের মানুষ, পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে হারিয়েছিÑ তেমনিভাবে শেখ মুজিবুর রহমানও এক ভোরে একদল ঘাতকের নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘অকথ্য নির্যাতন, লাঞ্ছনা, মৃত্যু সহ্য করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আর এ স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান।’
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘একটি সদ্য স্বাধীন দেশে অসংখ্য সমস্যা ছিলো। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সমস্যা, দারিদ্র্য দূর করার সমস্যা। সে সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় জন্মলগ্নের মুহূর্তে একটি জাতির নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো। পৃথিবীতে এমন নজির খুব বেশি নেই।
আমেরিকা স্বাধীনতা লাভের বহু বছর পর আব্রাহাম লিংকন নিহত হয়েছিলেন।’তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে যে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়Ñ তা ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে দেখেছি, শ্রীলংকায় ইদানিং দেখছি। বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যদিয়ে আর্থিক, সামাজিক প্রগতি বাস্তবায়ন করেছে। অথচ এ দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর বেশি হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছ, এর কারণ কী।’
তিনি বলেন, ‘ব্রহ্মদেশে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক শাসন চলেছে। এখন অবশ্য গণতন্ত্র আছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই সামরিক শাসন আসে। কোন্ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পরিস্থিতিতে সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বের হয়ে আসে?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সম্মিলিত কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তী ও তার দলের নৃত্য পরিবেশনের মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতিকে বরণ করে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট ডিগ্রি পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে প্রণব বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ, অভিভূত। আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকে ডি-লিট উপাধি দিয়ে আপনারা আমাকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করেছেন।’
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি কামনা করে বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয় একসময় তক্ষশীলা, নালন্দার মতো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হবে। এখানে বিশ্বের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা জড়ো হবেন জ্ঞান অর্জনের জন্য। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা তা পারবেন। কারণ, আপনাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল বিশ্ব মানবতার মুক্তি। এ মুক্তির কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন। সে মুক্তির জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক প্রাণ দিয়েছিলেন। আশা করি এ প্রাঙ্গণ সংকীর্ণ হবে না।’
এর আগে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনিরুজ্জামান, জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে স্বাগত জানান।
বাসস