Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

যেন হুইলে বন্দি রৌমারীর তাঁতীদের জীবন

মাজহারুল ইসলাম, রৌমারী প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ১০ নভেম্বর ২০১৬

আপডেট: ১৩:২৫, ১০ নভেম্বর ২০১৬

প্রিন্ট:

যেন হুইলে বন্দি রৌমারীর তাঁতীদের জীবন

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

কুড়িগ্রাম : প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংকট, বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের অতিরিক্ত ব্যয়, বিনিয়োগের অভাব, সুদের চাপ, বিক্রিত পণ্যের টাকা বকেয়া, ভারতীয় কাপড়ের দৌরাত্ম্য, মধ্যসত্ত্বভোগীদের দাপট, বাজারজাতকারণে বিঘ্নতা এমন হাজারও সমস্যা থাকলেও হুইলেই যেন বন্দি রৌমারীর সাড়ে ৫’শ তাঁতী পরিবারের জীবন।

বাপদাদার এ পেশা পারছে না ধরে রাখতে পারছেনা ছেড়েও দিতে। সর্বশান্ত পরিবারগুলো সুদিনের অপেক্ষায় রয়েছে। চায় রৌমারীর তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। ফিরে আনতে চায় কাকডাকা ভোর থেকেই গ্রামের পর গ্রামজুড়ে তাঁতীবাড়ির খট্ খট্ শব্দ।

গত মঙ্গলবার উপজেলার নামাজেরচর, চরকাজাইকাটা, ফুলকারচর, ওয়াহেদ নগর, চরশৌলমারী, সাহেবের আলগা, মিয়ারচরসহ অনেক গ্রাম ঘুরে দেয়া গেছে, তাঁতীদের সব তাঁত বন্ধ। যদিও শীতের প্রস্তুতির জন্য এখন তাঁতগুলো রাত-দিন চালু থাকার কথা। তাঁতীদের চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা। গোটা এলাকা জুড়েই নিরবতা আর শূণ্যতা।

এরই মধ্যে কেউ কেউ কিছু জমি বিক্রি করে সুতার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁতগুলোতে বছরভর জমে থাকা ধুলোবালির আস্তরণ মুছে নতুন আশায় শুরু করেছেন আবার। এখানে সাধারণত শাড়ি, লুঙ্গি, শীতের চাদর ও মাফলার তৈরি করেন ওরা। ভরা শীতে একটি চাদর বিক্রি হয় ৪’শ থেকে ৪২০ টাকায়। লুঙ্গি ১০০ থেকে ৩’শ টাকায়। মাফলার ১০০ থেকে দেড় ’শ টাকায়। শাড়ির বাজার তেমন ভাল নয় বিধায় সেটির কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই পরিবর্তন হয়েছে অনেক সরকার। ভোট পেয়ে সংসদ সদস্যের গদি দখল করেছেন গোলাম হোসেন, গোলাম হাবিব, জাকির হোসেন ও বর্তমানে রুহুল আমিন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। ঘটা করে সমাবেশ ও প্রতিশ্রুতি। পরে সব আগের মতই। এমনকি ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরাও এর বাইরে নন। ভোটের আগে তাঁতীদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ভোট নিয়েছেন তারাও।

ভোটের পর নিজের সীমাবদ্ধতার অজুহাত দিতে কার্পন্ন করেননি। একপর্যায়ে তাঁতীরা ধর্ণা দিতে শুরু করেন উচ্চ পদস্থ আমলাদের দ্বারে। যারা রৌমারীর সন্তান। তারাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আকাশ ছোঁয়া। তাঁতীরা আবার বুক বেঁধেছেন নতুন আশায়। কিন্তু ‘যাহা বাহান্ন তাহা তেপ্পান্ন’র মতোই অবস্থা। তাঁতীদের কপাল আর ফেরেনি।

‘একদিকে তাঁতগুলো বন্ধ, অন্যদিকে শীতের শেষে ঋনদাতারা মাথার উপরে খড়গ নিয়ে হাজির হবে। কিছুই বুঝতে চাবে না।’ এমনটাই জানালেন নামাজেরচর এলাকার মিজান তাঁতী।

তিনি বলেন, ‘ঢাকার নারায়নগঞ্জের এক মহাজনকে ৪ লাখ টাকার চাদর বাকিতে দিছিলাম ২ বছর আগে। হ্যায় টাকা দিছে মোডে ২ লাখ। বাকি টাকা এহনতুরি পাই নাই। পরের বার দিলাম টাঙ্গাইলে। হ্যারও একই দশা। এহানকার বাজারগুলাতে এতো মাল বেচন যায় না। হ্যাশামেশা ওই বাটপারদেরই কাছে যাওন লাগে। হ্যারাও সুযোগ বুইঝা আমগোর তবিল মাইরা দেয়। এহন পুঁজির অভাবে শীতের মাল তৈরিতে হাতই দিতে পারি নাই।’

একইভাবে আবুল হোসেন নামের এক তাঁতী বলেন, এককালীন অনুদান, বিদ্যুতের সুব্যবস্থা এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাত থেকে আমাদের বাঁচালে আমরা আগের মতো আবারও বাঁচিয়ে তুলতে পারবো হারিয়ে যাওয়া তাঁত শিল্পকে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক পরিপত্রে ক্লাস্টার আকারে পুঁজিহীন তাঁতীদের মাঝে স্বল্প লাভে ঋন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। স্থানীয় সকল ব্যাংক এর আওতায় পড়বে এবং বাস্তবায়ন করবে এমনটাই বলা আছে পরিপত্রে। ওই সুত্র ধরে ইতোমধ্যেই ইসলামী ব্যাংক রৌমারী শাখা ৪১জন তাঁতীকে স্বল্প লাভে ঋন দেয়ার ক্লাস্টার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে।

অবশ্য এর আগে পরীক্ষামূলক ১০জন তাঁতীকে ৫০ হাজার করে টাকা ঋন দিয়েছিল ইসলামী ব্যাংক। এটা নিঃসন্দেহে মরু সাহারায় এক পশলা বৃষ্টির মতই প্রশান্তির বলে জানালেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক মন্ডল।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করে আসছি আমার ঐতিহ্যের তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। অবশেষে ইসলামী ব্যাংক প্রথম পর্যায়ে ৪১জন তাঁতীকে অল্প লাভে ঋন দিতে সম্মতি দিয়েছে এজন্য ইসলামী ব্যাংককে ধন্যবাদ।

ইসলামী ব্যাংক রৌমারী শাখার শাখা ব্যবস্থাপক ওবায়দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, আমরা প্রথম পর্যায়ে ৪১জন তাঁতীকে স্বল্প লাভে ঋনের আওতায় নিয়ে এসেছি। পর্যায়ক্রমে সকল তাঁতীকে আমরা এ ঋনের আওতায় নিয়ে আসবো। সেটা সময়ের ব্যাপার। এর আগে অন্যান্য ব্যাংকগুলো এ ঋণের হাত বাড়িয়ে দিতো তাহলে আরও সুবিধা হতো। এছাড়াও সরকারীভাবে ঋন না দিয়ে এককালীন অনুদান, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান ও বাজারজাতকরণে সহযোগিতার হাত বাড়ালে মৃতপ্রায় এ শিল্পটি আবার দাঁড়াতে পারতো।

কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য রুহুল আমিন জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ওই এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের তাঁত শিল্পে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে যা করা প্রয়োজন সবই করা হবে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer