Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভাস্কর্য বিতর্ক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এক নৌকায় পা রাখুন!

সোহানুর রহমান

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ১৪ মে ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

ভাস্কর্য বিতর্ক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এক নৌকায় পা রাখুন!

ঢাকা : দেশে মুর্তি কিংবা ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধ নতুন নয় । কালে কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য মুর্তি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে দিবালোকে কিংবা গভীর রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে। আমরা একে সাম্প্রদায়িকতা বলি। যারা এহেন কার্যক্রম করেন তাদের পরিচয় দু:স্কৃতিকারী। ওসব কথা আপাতত বাদ। আমার দেশে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন সংখ্যালঘু নির্যাতন কম-বেশি রুটিন ওর্য়াক। যদিও আমি সংখ্যালঘু শব্দটা ব্যবহার করতে নারাজ। কিন্তু সংখ্যালঘু শব্দটা দারুণ এক ইস্যু।

এ ব্যাপারে মুখে মুখে সবাই নো কম্প্রোমাইজ হলেও অন্তরে অন্তরে অনেকেই সংখ্যালঘুর সম্পত্তি, তাদের স্ত্রী-কন্যা ভোগ করা হালাল মনে করে থাকেন। বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশের বাইরের কোন দেশ, সবকালেই সবসময়ই কম সংখ্যার ভিন্নমতালম্বীরা নির্যাতন নিষ্পেষণের শিকার হয়ে আসছেন। যদি ধরেন ভারতে গরুর গোশত খাওয়ার অভিযোগ তুলে আখলাক হত্যাকান্ড। আর বার্মার কুর্কীতিতো বিশ্বজোড়া্।

ধান ভানতে শীবের গীত না গেয়ে এবার আসি মূলকথায়। মিজানের প্রতীক দাড়িপাল্লা। মুদির দোকানে বহুবার দেখেছি। ২০০১ সালের ভোট গণনার সময় প্রথম বিটিভির পর্দায় দাড়িপাল্লা প্রতীক দেখলাম। যেটা ছিল জামায়েত ইসলামীর নির্বাচনী প্রতীক। সেবার বিএনপির সাথে জোট বেধে রাস্ট্রক্ষমতায় এসেছিল তারা। যদিও এখন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মনবতাবিরোধী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার গুরুতর অভিযোগে জামায়াত নিষিদ্ধ।

সুপ্রিমকোর্টের ন্যযবিচারের প্রতীক আর জামায়াতের প্রতীক মিলে যাওয়ায় দাড়িপাল্লা প্রতীককেও জব্দ করা হয়েছে চিরতরে। আরো একবার দাড়িপাল্লা দেখছি টিভির পর্দায় ভারতীয় বাংলা সিনেমাতে। বাংলা সিনেমার একটি বিশেষ ও উপভোগ্য অংশ হচ্ছে আদালতে উকিল সাহেবদের বাহাস। জজ সাহেব হাতুড়ি পিটিয়ে অর্ডার অর্ডার বলে রুলিং দিয়ে এজলাস নিয়ন্ত্রনে আনতেন। মাথার উপর ঝুলত সমান কাটার একটি নিক্তি বা দাড়িপাল্লা। তবে ভারতের চিত্রটা একটু ভিন্ন। সেথানে দাড়িপাল্লা ছিল এক নারীর হাতে যার অন্য হাতে খোলা তলোয়ার। দু’চোখ কালো কাপড়ে বাধা। দেখে খুব অর্থবহ মনে হয়েছিল।

শৈশবের অবচেতন মন নিশ্চিত বুঝে গিয়েছিল এটা দ্বারা নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার বোঝানো হয়েছে। বুঝে গিয়েছিলাম হাকিম নড়েতো, হুকুম নড়েনা। সেই ছোট্ট মনে আক্ষেপ জন্মেছিল আমাদের দেশে শুধু দাড়িপালল্লা কেন্? ওদেরতো কত সুন্দরভাবে প্রতীকি বিচারকের দু’চোখ কালো বাধা থাকে। এই প্রশ্নটা ছোটবেলা থেকেই মাথায় ঘুরপাক খেলেও আজো কাউকে বলা হয়নি।

তবে এখন বুঝেছি ওই নারীই হচ্ছেন গ্রীকদেবী থেমিস। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রনাথ সিনহা’র ইচ্ছায় ওকে ঠাঁই দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গনে। এতে একপক্ষ রুষ্ট হয়ে লেডি জাস্টিস বা জাস্টিসিয়া মুর্তি অপসারণের আল্টিমেটাম দিয়েছে। যার সাথে আমাদের স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একমত পোষণ করেছেন। কেউ আবার বলছেন ভাস্কর্যটি থাকলে সমস্যা কি? থাকা না থাকা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। তবে সরকারের মাথা ব্যথা হচ্ছে মুর্তিটি সুপ্রিমকোর্ট মসজিদ এলাকায় কে গাড়ল?

বসালো বসালো তাতে আবার শাড়ি পড়ালো কেন? পড়ালো পড়ালো তাকে এখন বোরকা পড়িয়ে ঢেকে রাখতে হবে । আমিতো শুনে হাসতে হাসতেই মরে যাই। বিটিভি খুললেই আগে ইনু সাহেবকে জাতির উদ্দশ্যে বলতে শুনতাম, পথ দুইটা। একটি প্রগতির পথ আর একটা জঙ্গির পথ। সিদ্ধান্ত নিয়ে একপথে চলতে হবে। তেঁতুল হুজুর করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলেন ভদ্রলোক।

এখন ইনু-মেনন সাহেবরা নিশ্চুপ কেন? এখন কি তবে দুইপথ মিলে একাকার হয়ে গেছে? তেঁতুল মিষ্টি হয়ে গেছে?? একসাথে যেমনি চা আর কফি খাওয়া যায়না, ঠিক তেমনি এক নৌকায় উনু-মেনন-শফি চড়তে পারেনা। এ দেখি ভাই ‘তেঁতুল পাতা তেঁতুল পাতা-তেঁতুল বড় টক, তোমার সাথে প্রেম করিতে আমার বড় শখ’। একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা উচিত বলে মনে করবেন আর স্বার্থের খাতিরে খেলাফত মজলিশের সাথে জোটবদ্ধ হবেন। একদিকে বলবেন নারী নেতৃত্ব হারাম, আর সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে হাত মিলিয়ে বলবেন, নারী তেঁতুল; খালি আরাম আর আরাম। এসব নির্ঘাত ভন্ডামি, বড়ই বেমানান, একসাথে যায়না।

৫ মে হেফাজতের আন্দোলন নিয়ে দেশে জল কম ঘোলা হয়নি। পাঠ্যপুস্তক পাল্টে তার ভিতর কাউয়া ঢুকিয়ে, বির্তকিত বাল্যবিবাহ আইন পাশ করে, কওমী সনদ দিয়ে যতই তেতুল হুজুরদের রাজি খুশি রাখার চেষ্টা করুন কোনদিনও তারা আপনাদের নৌকায় চড়বেনা। বরং ফুটো করে মুজিবের নাও ডুবিয়ে দেবে মাঝ দরিয়ায়।

একদিকে বিসমিল্লাহ তুলে দেবেন, রাষ্ট্র ধর্ম উঠিয়ে দেবেন; আর অন্যদিকে মদিনা সনদ দিয়ে দেশবে চালাবেন, এ কেমন যেন সাংর্ঘষিক কথাবার্তা । সুপ্রিমকোর্ট থেকে জাস্টিশিয়া সরাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপানি সহমত। তাহলে তারা যে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে এর সাথে কেন সহমত হচ্ছেন না? একবার বলাকা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের গড়া সব ভাস্কর্য উল্টে দিল দুর্বৃত্তরা! এভাবে আরো অনেক ভাস্কর্য তুলে ফেলার দাবি উঠতে সময় লাগবেনা। তাহলে কি দোষ করেছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত সরকারি বেকার হোস্টেলর ধর্মপ্রাণ ছাত্ররা।

‘অল বেঙ্গল মাইনরিটি ইয়ুথ ফেডারেশন’ (এবিএমওয়াইএফ) নামের একটি সংগঠনটি চেয়েছিল হোস্টেলে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ মুর্তিটি তুলে ফেলে ধর্মীয় পরিবেশ কায়েম করতে। এবিএমওয়াইএফের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুজ্জামান মিডিয়াকে স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘ইসলাম ধর্ম মূর্তি নির্মাণকে অনুমোদন করে না। বেকার হোস্টেল মুসলিম শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য। আমরা মনে করি, এখানে শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি রাখাটা ইসলামবিরোধী।’

পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হস্তক্ষেপে আবক্ষ মুর্তিটি রক্ষা করা গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুর্তি যেহেতু আপনা পছন্দ না, জাস্টিশিয়া যদি সরাতেই হয় তবে দেশের আনাচে কানাচে অনেকের মুর্তি আছে, সব সরিয়ে ফেলে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে দিননা। শুধু মদিনা সনদে দেশ চালিয়ে আসল কাজের কাজ কিছুই হবেনা। আহমেদ ছফা বলছিলেন, “আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু আওয়ামী লীগ জিতবে। আর তারা হারলে সমগ্র দেশ ও জাতি হেরে যায়।” আমরা হারতে চাইনা। বাংলাদেশ হারতে চায়না।

শেষ করবো আর একজন মানুষের কথা বলে। তার আগে একটু এরশাদ সাহেবের কথা বলে নেই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে তিনিই রাজনীতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্মের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। ৫মে’তে হেফাজতের আন্দোলনেও তার ছিল পুরোপুরি সমর্থন। তিনি যে দলের প্রধান, এখন সে দল জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল। তাদের কয়েকজন মন্ত্রীও নাকি সরকারে আছেন। আর তিনি আছেন আরো উচ্চপর্যায়ে, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। কি দূতিয়ালিটাই যে উনি করেন তা আমি ভেবে পাইনে।

আমি শুধু বলতে চাই আমাদের বরিশালে সন্তান কমরেড রাশেদ খান মেননের কথা। রাজনৈতিক পরিবারেই জন্ম এ জননেতার। যদিও তার বোন সেলিমা রহমান খালেদা জিয়ার খুবই ঘনিষ্ঠজন। রাশেদ সাহেব বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী হিসেবে সরকারের শরীক হয়ে রুটি হালুয়া ভাগ নিচ্ছেন। কিন্তু সব প্রগতিবিরোধী কার্যক্রমে তিনি একেবারে মুথে কুলুপ এটে রয়েছেন। অন্যদিকে তার দল বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি সুন্দরবন বাঁচাতে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে গাইছে:
‘ঝিঙ্গে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা/বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচনা। ঘরদোর বেচো ইচ্ছে হলে করবো নাকও মানা/ হাতের কলম জনম দুখী তাকে বেচো না।’

আমরা যেমন ব্যক্তিস্বার্থের কাছে আমাদের নীতি বিকিয়ে দিচ্ছি। বিবেক ও মনুষত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। তেমনি আমাদের নেতারা, আমাদের রাজনীতিবিদরাও অনেক কিছুই বিকিয়ে দিচ্ছেন। যেমন করে বিকিয়েছেন ফুলবাড়ি কয়লা খনি কিংবা রামপাল। আর নাসরীন হকরা সোচ্চর হতে গিয়ে বেঘোরে হারাচ্ছেন মূল্যবান প্রাণ। তবুও স্বপ্ন বেচা যাবেনা।

দেশের স্বার্থ বিকিয়ে আপোষ করা যবেনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতান বাস্তবায়নের পাশাপাশি একটি অসাম্প্রদায়িক ক্ষুধা, দারিদ্র ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমাদের তরুণ সমাজকেই জেগে উঠতে হবে। যে হাতে আমার পূর্বপ্রজন্ম অস্ত্র ধরেছিলো দেশকে- দেশের মানুষকে- আমাদের মা-কে রক্ষা করতে, সেই হাতেই আমরা কলম ধরি। সেই কলমও আমরা বেচবো না।

লেখক: যুব সংগঠক ও তরুণ সাংবাদিক: নির্বাহী প্রধান, প্রতীকি যুব সংসদ

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer