Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণকর্মী বাড়াতে হবে : অধ্যাপক ইসমাইল

মো. আউয়াল মিয়া, বাকৃবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৩:২১, ১৭ এপ্রিল ২০১৭

আপডেট: ২২:১৪, ১৭ এপ্রিল ২০১৭

প্রিন্ট:

প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণকর্মী বাড়াতে হবে : অধ্যাপক ইসমাইল

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

ময়মনসিংহ : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষক ও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণকর্মী বাড়াতে হবে। কৃষকের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো অতিদ্রুত সমাধান করতে হবে। তাহলে দেশ বাঁচবে, জাতি বাঁচবে ও কৃষক বাঁচবে।

তিনি আরো বলেন, কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলেও উৎপাদন কিন্তু কমে নি। বরং উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে। দেশের বাইরে আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানী হচ্ছে। অথচ এই কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য ও প্রাপ্ত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষিপণ্য বিতরণের ক্ষেত্রে মধ্যস্বভোগী কমাতে হবে। কৃষি ব্যবসা প্রসার করা ও কো-অপারেটিভ মার্কেট ( অনেক কৃষক মিলে যে মার্কেট তৈরি) গঠন করে দাম নির্ধারণ করতে হবে। কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশ। সবুজ ঘেরা ও শস্য শ্যামলার দেশ আমাদের বাংলাদেশ।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, সবুজ শস্যকে ঘিরে রয়েছে কোটি কোটি কৃষক। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ আজ খাদ্য প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই কৃষকেরা নানা কারণে কৃষি দ্রব্যর ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। ফলে তারা অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। এভাবে কৃষি পেশা থেকে কৃষকেরা অন্য পেশায় চলে হয়ত দেশে আবারও খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। তাই অতি দ্রুত কৃষিবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে কৃষিদ্রব্যর সঠিক দাম নিশ্চিত করতে হবে।

সম্প্রতি বহুমাত্রিক.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন।

কৃষক, কৃষিপণ্য ও কৃষি ব্যবসার নানা রকম সমস্যা ও উত্তোরণের উপায় শীর্ষক সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।

বহুমাত্রিক.কম এর পক্ষ থেকে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন এর সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি মো. আউয়াল মিয়া।

বহুমাত্রিক.কম : কৃষকেরা কি কারণে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না এবিষয়ে আপনার কি মনে হয়-যদি বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা দিতেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কৃষকের সঠিক পরিকল্পনার অভাব মূলত দায়ী। তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। দ্রব্যর গুরুত্বের পাশাপাশি বাজারকে গুরুত্ব না দেয়ায় কৃষকেরা সঠিক দামে ফসল বিক্রি করতে পারছে না।

বহুমাত্রিক.কম : কৃষকেরা কি কি পদক্ষেপ নিলে ন্যায্যমূল্য পেতে পারে- এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন করার পাশাপাশি বিকল্প শস্য চাষ করা, জমির বিকল্প ব্যবহার সুযোগ না করা, চাল করে বিক্রি না করা, কৃষি পণ্যর বাজারজাত করা ও কৃষি ব্যবসা সম্প্রসারণ করলেই ন্যায্যমূল্য পেতে পারে।

বহুমাত্রিক.কম : উৎপাদনে ব্যয় কীভাবে কমানো যেতে পারে-এ বিষয়ে আপনার অভিমত?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে, পরিবারের শ্রমিক ব্যবহার করেও উৎপাতন ব্যয় কমানো যেতে পারে। এ ব্যাপারে কৃষকেরা যদি কৃষি অর্থনীতিবীদদের সহায়তা নেয় তাহলেও ব্যয় অনেকাংশেই কমানো যেতে পারে।

বহুমাত্রিক.কম : কৃষি বিপণনের ক্ষেত্রে কৃষকদের ভূমিকা কি রকম হওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : ধান, ডাল, গম, তেলবীজ, যব, যব, আলু, মশলা, ভুট্টা, তামাক, শাক-সবজি, ফলমূল, চা, আখ, পাট, তুলা, রেশম, রবারসহ সকল ধরণের কৃষিজাত দ্রব্য কৃষকেরা উৎপাদন করে। এইসকল দ্রব্য থেকে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন ধরণের পণ্য তৈরি করা যায়। যেগুলোর চাহিদা বাজারে রয়েছে।দেশের বেশীরভাগ শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্যর কাঁচামাল সিংহভাগই আসে কৃষি থেকে। বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প, পাটশিল্প ও কুটির শিল্পের কাঁচামাল। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্নপ্রকার কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করে আয় করে এই দেশ। সরকারের আয়ের বিরাট অংশও কৃষিখাত থেকে আসে। তাই কৃষকদেরকে প্রক্রিয়াজাত পণ্যর দিকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলে মিলে যদি বিশাল পরিমাণ দ্রব্য সঞ্চয় বা জমা করে রাখতে পারে তাহলে তাদের দাম নির্ধারণের সক্ষমতা বেড়ে যাবে। এভাবে কৃষকেরা বেশী দাম পেতে পারে।

বহুমাত্রিক.কম : কৃষিজ পণ্য বিক্রির জন্য আসলেই কি মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের প্রয়োজন আছে কি-বিষয়টি যদি একটু বিস্তারিত বলতেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কৃষিজ পণ্য বিক্রির জন্য অবশ্যই মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের প্রয়োজন আছে। তবে এদের সংখ্যাটা কমাতে হবে। কারণ কৃষকের পক্ষে দর-দামকষাকষি সম্ভব হয়না। কৃষিপণ্য বড় বাজারে ও আর্ন্তজাতিক বাজরে বিতরণের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের প্রয়োজন আছে।

বহুমাত্রিক.কম : অধিকাংশ মুনাফা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হাতে চলে যাওয়ার মূল কারণটা কি- এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সংখ্যা অনেক বেশী হওয়াই মূলত এমনটা হয়। কারণ একটি পণ্য যতগুলো হাতবদল করবে সেই পণ্যর ক্ষেত্রে ততগুলো মূল্য যোগ হবে। আমাদের দেশে এমনটাই হয়ে থাকে। ফলে মুনাফাগুলো মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হাতে চলে যায়।

বহুমাত্রিক.কম : সুষমবন্টন অর্থনীতিতে উৎপাদক ও ভোক্তাদের বাজার কিরুপ হওয়া উচিত- এ বিষয়ে আপনার অভিমত?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : সুষমবন্টন অর্থনীতিতে উৎপাদক ও ভোক্তাদের বাজার আসলে আদর্শ বাজার হওয়া উচিত। সেই সাথে পূর্ণপ্রতিযোগিতা সম্পন্ন বাজার হলে ভাল হয়। যদিও এটা পুরোপুর সম্ভব না তবে চাহিদা ও সরবারাহের উপর ভিত্তি দাম নির্ধারণ করে উৎপাদকেরা ভাল দামে বিক্রি করবে এবং ভোক্তারা কম দামে পণ্যর সর্ব্বোচ উপযোগ ব্যবহার করবে।

বহুমাত্রিক.কম : কৃষি ভর্তুকিতে আসলেই কি কৃষকেরা লাভবান হচ্ছে-এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : ইউরিয়া সারের ক্ষেত্রে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছে। আর অন্যান্য সার, বিদ্যুৎ ও সেচযন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হচ্ছে।

বহুমাত্রিক.কম ঃ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে কৃষিপণ্য ও কৃষিবীজের বাজার চলে গেছে? এটি জাতীয় অর্থনীতে কীরুপ প্রভাব পড়বে? বিষয়টা যদি একটু বিশদভাবে বলতেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : এখনো পুরোপুরি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর হাতে কৃষিপণ্য ও কৃষিবীজের বাজার চলে যায় নি। তবে প্রক্রিয়াজাত পণ্য, বীজ ও ইনপুট ফ্যাকটরগুলো কিন্তু তাদের হাতে। এটা জাতীয় অর্থনীতির উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে। এটা কৃষকদের ভবিষ্যতে দুর্ভোগ বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

বহুমাত্রিক.কম : নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যর সরবারাহ বাড়লেও দ্রব্যর দাম কমছে না কেন? বিষয়টি আপনার কি মনে হচ্ছে?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারণেই এমনটা হচ্ছে। পণ্য গুদামজাত করে রেখে রেখে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এজন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যর সরবারাহ বাড়লেও দ্রব্যর দাম কমছে না।

বহুমাত্রিক.কম : বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থা, দেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি বিপনণ কি রকম হওয়া উচিত? এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কৃষি বলতে মানুষের জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীজ সম্পদ উৎপাদন করেই বোঝায়। তাই কৃষি হচ্ছে এক ধরণের কাজ যা শস্য উৎপাদন, পশু-পাখি পালন, মৎস্যচাষ, বনায়ন প্রভৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মূলত কৃষির উপরনির্ভরশীল। কৃষির উন্নয়ন মানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন। জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ লোক এই কৃষির পেশায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা প্রায় ২৫ শতাংশ আসে এই কৃষি খাত থেকে। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিত বিভিন্ন খাদ্য শস্য, ফলমূল, শাক-সবজিসহ মাছ, ডিম, দুধ প্রভৃতি ধরণের খাদ্য জনগণের খাদ্যসহ যাবতীয় চাহিদা পূরণ করা করে। শিক্ষা ছাড়া মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোও এই কৃষির উপর নির্ভরশীল।

প্রাচীনকান থেকেই এ দেশের অধিবাসীরা পশুপালন করে আসছে। কৃষিকাজ পরিচালনা, পরিবহন, মাংস ও দুধ সরবরাবহ, পশমি বস্ত্র তৈরি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে আমাদের গ্রামাঞ্চলের লোকেরা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি গবাদি পশুপালন করে থাকে। তবে বেশি শস্য উৎপাদনের জন্য জমি, শস্যাদির স্থানান্তর, দুধ ও মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে গবাদি পশুর চাহিদা বর্তমানে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য পশুপালন একটি লাভজনক পেশা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দেশের অনেক বেকার লোক পশুপালনসসহ হাঁস-মুরগি ও কোয়েল পালনও স্বকর্মসংস্থানের অন্যতম উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে।

সম-সাময়িক সময়ে প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলে মাছ চাষ স্বকর্মসংস্থানের একটি অন্যতম উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। গ্রামঞ্চলের অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক এ পেশায় জড়িত হচ্ছে। তারা পুকুর, দিঘীতে মাছ চাষ করছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মাছ চাষের কলাকৌশল অনেক উন্নত হয়েছে। দ্রুত বর্ধনশীল নতুন নতুন প্রজাতির মাছ এদেশে আনা হচ্ছে। প্রকৃতির উপর নির্ভর না করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। পোনা উৎপাদন বা হ্যাচারীর মাধ্যমেও অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। এছাড়া বর্তমানে বনায়ন, নার্সারী, ফুলের বাগান করে আমাদের দেশের বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। দেশের প্রেক্ষাপটে কৃষিপণ্য যেন সঠিক দামে বিক্রি হয় সেইরকম বাজার হওয়া উচিত।

বহুমাত্রিক.কম : সরকারের প্রতি কোন পরামর্শ আছে কিনা?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণকর্মী বাড়াতে হবে। কৃষকের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো অতিদ্রুত সমাধান করতে হবে। তাহলে দেশ বাঁচবে, জাতি বাঁচবে ও কৃষক বাঁচবে।

প্রতিবেদক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer