Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

আত্মনির্ভরশীলতার গল্প: পথ দেখাবেন আফাজ-অলিরাই

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ০৮:১৪, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

আপডেট: ১১:২৯, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

প্রিন্ট:

আত্মনির্ভরশীলতার গল্প: পথ দেখাবেন আফাজ-অলিরাই

ছবি: লেখক

ঢাকা : আমাদের মাঝে এমন মানুষ রয়েছেন যারা সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিজেকে এবং সমাজকে করছেন আলোকিত। অনুপ্রেরণার পথ দেখিয়েছেন পিছিয়ে পড়া মানুষদের। নিজেদের স্বাভলম্বনের পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন অনেকের কর্মক্ষেত্র। শত হতাশার মাঝেও নীরবে জ্বেলে যাচ্ছেন আশার আলো। তারা আলোর পথযাত্রী।

তাদের প্রতিটি সাফল্য কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে অসীম সাহস, কর্মনিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস আর র্থনৈতিক মুক্তির নতুন চিন্তা-চেতনা। এইসব সাফল্যের সংগ্রামে নিয়োজিত মানুষের দিন বদলের গল্প আছে বাংলার ঘরে ঘরে। সেগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তোলে আনা হয় না। সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। বেসরকারি উদ্যোক্তরাও বাড়ায় না সহযোগিতার হাত। তারপরও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ.... এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ...

রাজশাহী অঞ্চলের নাটোরে খোলাবাড়িয়া একটি গ্রামের নাম। গ্রাম তো গ্রামই। গ্রামের নাম তো নামই। নামের কোনো পরিবর্তন হয়না বলেই জানি। কিন্তু এ গল্পে ঘটেছে তার ব্যতিক্রম। গ্রামের এক বৃক্ষপ্রেমিক আফাজ পাগলা বাড়ির পাশে ৫টি ঘৃতকুমারীর গাছ রোপণ করে। এই ঘৃতকুমারীরর গাছই বদলে দিয়েছে গ্রামটির নাম। বদলে দিয়েছে গ্রামের আর্থিক অবস্থা।

খোলাবাড়িয়া এখন ঔষধিগ্রাম নামেই অধিক পরিচিত। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে সেই আফাজ পাগলার ঘৃতকুমারীর চারা রোপণ বদলে দিয়েছে গ্রামবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি। ঔষধি গুণসম্পন্ন গাছের বদৌলতে বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা চেতনা এবং কর্ম। গ্রামের ১৬শ পরিবার এখন ঔষধি গাছের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের চারপাশে বিঘার পর বিঘা জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষাবাদ। যাদের জমি জমা নেই তারাও বাড়ির আঙিনায় যেখানে সুযোগ আছে সেখানেই চাষ করছেন ঘৃতকুমারীর। এই গ্রামে মোট ২৫ হেক্টর জমিতে ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়।

আশ্চর্য এই ঔষধি গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রির দোকান। শুধু নামে ঔষধি গ্রাম নয়, গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম এখন ভেষজ চাষাবাদ। বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে ‘ভেষজ বহুমুখি সমবায় সমিতি’। সমিতির মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা আর উৎপাদনকারীর সমন্বয়ে জমে উঠেছে ভেষজ বিপ্লব। আফাজ পাগলার ভেষজ প্রেমের অনুসারী হয়ে গ্রামের সবাই এখন ভেষজ চাষি। গ্রামের নারীরা একাজে অনেক এগিয়ে। ঔষধি চাষাবাদের জন্য এ গ্রামের নারীদেরকে বলা হয় ‘বনজ রানী’। এই গ্রামের মাটিরও নাম দেয়া হয়েছে ভেষজ মাটি।

আফাজ পাগলের ১৭ কাঠার চাষি জমিতে ৪৫০ প্রজাতির ভেষজ নার্সারি গড়ে তোলা হয়েছে। এসব নার্সারিতে আছে- বাসক, সাদা তুলসী, উলট কম্বল, চিরতা, নিম, কৃষ্ণতুলসী, রামতুলসী, ক্যাকটাস, সর্পগন্ধা, মিশ্রিদানা, হরিতকি, লজ্জাবতীসহ হরেক রকমের ঔষধি গাছ। গ্রামটিতে ৫শ কৃষক সব সময় ভেষজ চাষাবাদ করেন। কৃষকদের স্বার্থে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ভেষজ গাছ-গাছড়া উৎপাদন সমবায় সমিতি’।

জানাগেছে দেশে প্রায় ১শ কোটি টাকার ঔষধি কাঁচামালের স্থানীয় বাজার রয়েছে। এই ঔষধি গ্রামই এ চাহিদার অধিকাংশের জোগান দেয়। স্কয়ার ও এসবি ল্যাবরেটরিজের মতো প্রতিষ্ঠান এখান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে। ঔষধি গ্রামের এই ভেষজ চাষাবাদ এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী গ্রামগুলোতেও। এ যেন এক ভেষজ বিপ্লবের কাহিনী। এই যে ভেষজ বিপ্লব তার পেছনে নেপথ্য নায়ক একজনই- আফাজ পাগল।

গ্রামজুড়ে এখন পাগল আর পাগল। যে যত বেশি পাগল সে তত বড় কবিরাজ। সব কবিরাজের গুরু আফাজ পাগল। সেই-ই পথ দেখিয়েছে মানুষদের। উৎসাহ দিয়েছে, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছে এমনকি সহযোগিতাও করেছে ভেষজ চাষাবাদে। এখন সবাই একই পথের পথিক। বাংলাদেশে বোধকরি এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে সকল মানুষ একই পেশায় নিয়োজিত। ভেষজ গাছ-গাছড়ার চাষাবাদে আফাজ পাগলের এই দৃষ্টান্ত সকলের জন্য অনুসরণীয় হোক।
ঔষধি গ্রামের পর শুনুন এক মুড়ি গ্রামের গল্প। কুড় কুড়ে মুড় মুড়ে মুড়ি ভাজা বাঙালির প্রাচীন মোখরোচক খাবার।

মুড়ি ভাজাকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। এদের মাঝে নারীরাই উল্লেখযোগ্য। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে মুড়ি ভাজা পেশাদার বিছিন্নভাবে পাওয়া যায়। কিন্ত গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এপেশার ওপর নির্ভরশীল এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। একটি নয় দুটি নয় ঝালকাঠির দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালি, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরাকাঠি এই পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুড়ি তৈরির ওপর জীবিকা নির্বাহ করে।

এই গ্রামগুলোতে রাতদিন চলে মুড়ি তৈরির ব্যস্ততা। এই দপদপিয়ায় নাকি বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়। এখানে দুই পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজা হয়। যারা একটু স্বচ্ছল তারা নিজেরা বাজার থেকে ধান কিনে আনে। তারপর বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরি করে মুড়ি ভেজে নিজেরাই বাজারজাত করে। আবার যারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল তারা আড়তদারদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চাল আনেন। এই চালে মুড়ি ভেজে আড়তে সরবরাহ করেন। এতে তাদের লাভ কম হয়। তথ্যে জানা গেছে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক ২ মণ মুড়ি ভাজতে পারেন। এই গ্রামগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পালাক্রমে মুড়ি ভাজেন।

মুড়ি তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অনেক পরিবার দেখেছে স্বচ্ছলতার মুখ। তাই মুড়ি ভাজা এখন গ্রামে একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। একই স্থানে সমজাতীয় পেশা জনপ্রিয় হলে সে পেশাকে কেন্দ্র করেই শিল্পের জন্ম হয়। আমাদের জীবন জীবিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এসব শিল্প দেশজ স্বনির্ভরতার প্রতীক। তবে এশিল্পেরও অনেক সমস্যা আছে। মেশিনে মাধ্যমে সার মিশ্রিত মুড়ি অপেক্ষাকৃত কম খরচে তৈরি করে কম মূল্যে বাজারজাত করার কারণে এই গ্রামবাসীর রোজগারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মুড়ি সহজ উপায়ে সার মিশিয়ে তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো খুবই ক্ষতিকর।

সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই মুড়ি গ্রামকে বাণিজ্যিক মুড়ি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবা যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করব মুড়ি গ্রামগুলোকে বাণিজিকীকরণ করে আরো অধিক উৎপাদন এবং এ পেশায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন।

এবার শুনুন বৃক্ষপেমিক অলির স্বপ্নভুবনের গল্প। তিনি ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের আলাউল হক অলি। এই বৃক্ষপ্রেমিকের নেশায় পেশায় জড়িয়ে আছে গাছ। প্রায় ৬০ বিঘা জায়গাজুড়ে বিশাল এলাকায় তার বৃক্ষ উদ্যান।

তার এই উদ্যানই এখন হাজার মানুষের কর্মক্ষেত্র। ফুল, ফল আর ঔষধি সব রকমের গাছই আছে তার সংগ্রহে। তার উদ্যানের আছে বিশাল রেকর্ড। তার বাগানে ফলেছে ৮-১০ কেজি ওজনের বেল, ৫০০ গ্রাম ওজনের কামরাঙা, প্রমাণ সাইজের লেবু, বিশালাকৃতির জাম, জামরুল, আতা, কদবেলসহ নানান রকমের দুষ্প্রাপ্য আম, কাঁঠাল আর পেয়ারা। দোফলা, ত্রিফলা, বারোমাসি বিভিন্ন ধরণের আমের সংগ্রহ আছে তার কাছে। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে সব ভিন্ন ভিন্ন।

আছে- খাজাভোগ, কনে চাহনি, রাজদেশি, চিনি চমক, গোলাপবাস, মোহনভোগ, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলিসহ নানা বিরল প্রজাতির আম গাছ। ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরপুর তার বৃক্ষ উদ্যান। অলি দেশ ও বিদেশ থেকে নানান প্রজাতির ফলজ, বনজ আর ঔষধি বৃক্ষ সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন উপায়ে। এজন্য কারো কাছে মাথানত করতে তার যেন কোনো আপত্তি নেই। বিচিত্র চিন্তার এই সৃজনশীল কৃষক বৃক্ষের সাথে ভালোবাসায় নিমগ্ন অহর্নিশ।

তার উদ্যানে আছে- দেশিজাতের দারুচিনি, তেজপাতা, আমলা, খয়ের, হরিতকি, গোলমরিচ, চন্দন, কাঠবাদাম, কাউফল, পেস্তা, চালতা, আতা, লুকলুকি, সফেদা, জলপাই, আমলকি, জাম্বুরাসহ বিদেশি জাতের বেদানা, কফি, রিটা, লবঙ্গ ও মাল্টাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তার এই উদ্যান যেন পাখিদের অভয়ারণ্য। এত খাবার কোথায় পাবে বনের পাখি। কোথায় পাবে অমৃতস্বাদ, গন্ধসুধা। তাই শুধু পাখি নয় মৌমাছি আর প্রজাপতির এক বিচিত্র ভুবন এই উদ্যান। এখানে নাকি প্রায় হাজার দুয়েক বনো কবুতর বাস করে নির্ভয়ে। তার সাথে আছে পেঁচা, চড়ূই, ফিঙে, কোকিল, চিল, বকসহ কত রকমের পাখি।

অলি সাহেব আবার ওদের খাদ্য আর নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই যত্নশীল। ওরা যেন তার মেহমান। তাই বাসা বাধার সুবিধার্থে তিনি গাছের উচু ডালে মাটির হাড়ি-পাতিল বেধে রাখেন। তাছাড়া এতবড় উদ্যানের খাবার তো ফ্রি-ই থাকছে। এসবের পাশাপাশি অলি সাহেবের রয়েছে বেশ কয়েকটি পুকুর। ওখানে চলছে রকমারি মাছের চাষ। পাশাপাশি গবাদিপশুর খামারে আছে গরু, ছাগল, ভেড়া আর মহিষ। আলাউল অলি শুধু নিজের বাগানের যত্ন করেই ক্ষান্ত থাকেন না। রকমারি গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেন আত্মীয়-স্বজন আর পারা-প্রতিবেশির মাঝে।

একজন অলির একান্ত চেষ্টায় গড়ে উঠা উদ্যান হতে পারে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির আঙিনাজুড়ে বৃক্ষ রোপনের সুযোগ নিতে পারি। বৃহৎ উদ্যান না হলেও নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারলেই তো লাভ। আমরা প্রত্যকে যেন কমপক্ষে ৩টি করে লাগাই। কেননা আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই।

লেখক : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক

[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer