ঢাকা : শিক্ষকতা মহান পেশা হলে শিক্ষক হচ্ছেন মহত্তম। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা স্বমহিমায় বিশুদ্ধ জ্ঞান, মানবিক আর নৈতিক শিক্ষায় দিক্ষিত করে গড়ে তুলেন যোগ্যতম নাগরিক। প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের নাগরিক জীবনে শিক্ষকের আদর্শিক প্রভাব নানাভাবে প্রেরণার পথ দেখায়।
যদিও বর্তমান সময়ে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়ও আদর্শের অনুপস্থিতি প্রকট রূপ নিয়েছে, তথাপি কালের আয়নায় এখনো অবারিত আলোকিত মনবতা বোধের পথ দেখায় অনেক মহত্তম শিক্ষকের রেখে যাওয়া আদর্শ আর দেখিয়ে দেয়া পথ। তেমনি একজন শিক্ষক শাহ আজিজ স্যার (মরহুম)। যিনি তাঁর একজীবনের শিক্ষকতা পেশায় রেখে গেছেন অজ¯্র মানবীয় দীক্ষার নজির।
গ্রামের নামানুসারে শাহ্ আজিজ স্যার প্রিয় ছাত্র ও অভিভাবকদের কাছে সিংধার আজিজ স্যার নামেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। হাস্যেজ্জল, সদালাপী, রঙ্গরসময় এবং সরল-কোমল মনের অধিকারি ছিলেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীরা ছিলো তার প্রাণপ্রিয় সন্তানের মতো। বন্ধু মতো প্রাণখোলা সরলতায় মিশতেন শিক্ষার্থীদের সাথে।
নেত্রকোনা জেলায় স্কাউটিং বিকাশের অগ্রদূত ছিলেন শাহ আজিজ স্যার। শরীরচর্চা এবং ক্রীড়াঙ্গনে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার প্রতীক। শাহ্ আজিজ স্যার নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়কে সংস্কৃতি, ক্রীড়াঙ্গন এবং স্কাউটিংয়ে অনন্যমাত্রায় পরিচিতি দিয়েছিলেন। একাজে নিজের সবটুকু শ্রম, মেধা, সেবা আর দক্ষতাকে বিলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের মাঝে।
শাহ্ আজিজ স্যারের নেতৃত্বে নেত্রকোনা জেলায় স্কাউটিং বিকশিত হলেও বাংলাদেশ রুভার স্কাউটস তাঁকে যথাযথ মর্যাদা বা স্বিকৃতি দেয়নি। শাহ্ আজিজ স্যারের নিপুণ দক্ষতায় গড়ে তোলা স্কাউটার বাংলাদেশ স্কাউটিংয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল পদক অর্জন করে মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়কে গৌরবোজ্জ্বল পরিচিতি এনে দিয়েছে। শাহ্ আজিজ স্যার শুধু ছাত্রদের কাছে নয়, অভিভাবকদের কাছে ছিলেন প্রিয় একজন শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীদের যেকোনো সমস্যা আর বিপদে তিনি ছিলেন পরমাশ্রয়, পরিত্রাণদাতা।
বিশেষত ভাটিবাংলার দূর দূরান্তের শিক্ষার্থীদের এবং গরীব শিক্ষার্থীদের বেলায় তিনি ছিলেন একমাত্র ভরসাস্থল। যে শিক্ষার্থীর বেতন মওকুফ দরকার, বেতন কমানো দরকার আছেন প্রিয় শাহ্ আজিজ স্যার। যে ক্লাশের শিক্ষার্থীই হোকনা কেন তিনি তার সমাধানে শ্রেণী শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষকের কাছে অসংকোচে সুপারিশ করতে দ্বিধা করতেন না। তবু তিনি চাইতেন ছেলেমেয়েরা কোনোভাবে মেট্রিকটা পাশ করুক। তাহলেই কৃষক পিতার কিছুটা হলেও দুঃখ গোচাতে পারবে। অজপাড়াগাঁয়ের অসংখ্য গরীব শিক্ষার্থীর এবং তাদের অভিভাকদের কাছে তিনি ছিলেন একমাত্র ভরসাস্থল।
গরীব এবং মেধাবি অথচ গরীব এমন শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে তিনি শহরের ধনী শিক্ষার্থীদের পুরণো বই সংগ্রহ করে দিতেন যাতে নতুন বই কিনতে না পারলেও তারা পড়া চালিয়ে যেতে পারে। তিনি অনেক গ্রামে এবং মোহনগঞ্জ শহরের অবস্থানরত ছাত্রদের বাসা বাড়ীতে যেতেন অভিভাবকদের আহ্বানে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানের পড়াশুনা ও ভবিষ্যত সম্পর্কে স্যারের পরামর্শ নিতেন। তিনি স্কুলের সৌন্দর্য এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় অগ্রনী ভুমিকা রাখতেন।
প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্যান্য শিক্ষকরাও শাহ্ আজিজ স্যারের প্রতি সহবান্ধব ছিলেন। কারণ স্কুলের নানান সমস্যা সমাধানেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ছিলেন স্যারের অনুগত এবং ভক্ত। তেমনি স্যারও ছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নিবেদিত প্রাণ, বন্ধুপ্রতীম।
মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়টি নিকটস্থ ভাটি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ বিদ্যাপিঠ হিসেবে সুপরিচিত। আর এই বিদ্যাপিঠের সুনাম রক্ষা এবং বিকাশে শাহ্ আজিজ স্যারের অনন্য অবদান অনস্বীকার্য। স্যার ছিলেন রসিক মানুষ- ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সাথে অবলীলায় হাস্যরস করতেন। কোনো বিষয়কেই জটিলভাবে দেখতেন না। সমাধান খুঁজতেন সহজ পথে। দ্বীধা, অহমিকার কোনো দম্ভ ছিলো স্যারের মাঝে।
মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়টির ক্রীড়া ও শরীরচর্চা, টিফিন, স্কাউটিং, সাংস্কৃতিক সব আয়োজনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান দায়িত্বশীল শিক্ষক। স্যার না হলে যেন চলেই না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক কতটা গভীর ও আন্তরিক আস্থাশীল হতে পারে তা কেবল স্যারের ছাত্র-ছাত্রীরাই অনুভব করতে পারবেন। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ক্রীড়ানুরাগী এই মহান শিক্ষকের প্রাণপ্রিয় স্থান ছিলো স্কুল প্রাঙ্গন। স্কুল ছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। স্কুল শেষে বাজারের বিভিন্ন দোকানে বসেও ঘন্টার পর ঘন্টা ছাত্র এমনকি অভিভাকদের সাথে দেখা সাক্ষাতে পরামর্শ ও সহায়তা করতেন।
স্যারের সহযোগিতায় বেতন মওকুফ পাওয়া, বিনামূল্যে বড় ভাইদের কাছ থেকে পুরণো বই পড়ে স্কুলের গন্ডি পেড়োনো অনেক কৃতি শিক্ষার্থী সমাজ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে স্বমহিমায় ভুমিকা রাখছেন। সবার প্রিয় সেই সিংধার শাহ্ আজিজ স্যার ১৯৯০ সালে দূরারোগ্যব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশা শিক্ষক সমাজের প্রতিটি শিক্ষক যেন হয়ে উঠেন সত্যিকারের নিবেদিত প্রাণ মানুষ গড়ার কারিগড়। স্যারের স্নেহধন্য শিক্ষার্থীরা আজ দক্ষ প্রশাসক, আমলা, বিচারক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ নানান পেশায় নিজেদের মেধার সাক্ষর রাখছেন। প্রিয় শাহ্ আজিজ স্যারের মতো এমন উপকারী শিক্ষক এযুগে সত্যিই বিরল। কালের মহিমায় অজ¯্র শিক্ষার্থীর হৃদয়ে এমন নিবেদিত শিক্ষক শাহ্ আজিজ স্যার বেঁচে থাকুন অযুত সময়। শাহ্ আজিজ স্যার স্কাউটারদেররক জারি সারি গান শেখাতেন। এখনো কানে বাজে সেই সুরে গাওয়া- জন্ম নিলাম সোনার বাংলা দেশে রে, এমন সুন্দর দেশ আর কোথাও নাই-ওরে.....।
এস এম মুকুল : কলাম লেখক ও উন্নয়ন গবেষক
বহুমাত্রিক.কম