ঢাকা : গত ১৩ জুন ২০১৯ তারিখে আমাদের মহান জাতীয় সংসদে ঘোষিত হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। এটি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের ১১তম বাজেট।
শুধু তাই নয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থাৎ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধু সরকারের ৭৮৬ কোটি টাকা দিয়ে যে জাতীয় বাজেটের সূত্রপাত হয়েছিল তা আজ কালের পরিক্রমায় সর্বকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এখন তা ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে এবার। শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিটি বাজেটের একটি সময়োপযোগী শ্লোগান থাকে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের (২০১৯-২০) বাজেটের শ্লোগানটি ছিল, ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’।
এ বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশ। মোট রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা, ঘাটতি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা, ব্যাংক ঋণ ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, এবং সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য ঋণ ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব আরো নানা পরিসংখ্যান বাজেট বিশ্লেষণে তুলে ধরে বাজেটের পূর্বে ও পরে অনেক বিশ্লেষকগণ বর্ণনা করে চলেছেন। তাছাড়া বাজেটের উল্লেখযোগ্য বরাদ্দগুলোর মধ্যে রয়েছে, জনপ্রশাসন-১৮.৫%, শিক্ষা ও প্রযুক্তি-১৫.২%, পরিবহন ও যোগাযোগ-১২.৪%, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন-৭.২%, প্রতিরক্ষা-৬.১%, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ- ৫.৬%, কৃষি-৫.৪%, জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ-৫.৪% এবং স্বাস্থ্য-৪.৯% ইত্যাদিই প্রধান।
দেখা যায় কৃষিখাতে মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ হিসাবে টাকার অংক দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হবে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি হিসেবে। কারণ কৃষি এবং কৃষককে বাঁচাতে হলে ভর্তুকির বিকল্প নেই।
কৃষিখাতে এবছরের বরাদ্দের পরিমাণ খুব বেশি না বাড়লেও বাজেটের আকার যেহেতু বেড়েছে কাজেই বরাদ্দের পরিমাণও আনুপাতিক হারে অনেক বেড়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় তা অনেক বেড়েছে। কিন্তু সীমিত বাজেটের মধ্যেই কৃষি এবং কৃষকবান্ধব বেশকিছু উদ্যোগ বিষয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনকে সামনে নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে। কারণ আমরা জানি আওয়ামীলীগ হলো কৃষিবান্ধব সরকার। এ সরকারের আমলেই কৃষি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
সরকারি নানা প্রণোদনা ও ভর্তুকি পাওয়ায় বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যোৎপাদান এত বেশি পরিমাণে বেড়েছে তা এখন আর রাখার জায়গটি পর্যন্ত হচ্ছে না। শুধু তাই নয় বিগত কয়েকবছর যাবৎ ধান-চালের ন্যায্যমূল্য না প্রাপ্তিতে কিছু অসন্তুষ্টি সবসময় ভরা মৌসুমে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কৃষক তার ফসলের উৎপাদন মূল্যই তুলতে পারছেন না। তবে এ বিষয়টি নিয়ে সরকার একটি উভয় সংকটে পড়ে প্রতিবছর। আর সেটি হলো নিম্ন আয়ের মানুষকে কম মূল্যে খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করাও সরকারের দায়িত্ব অপরদিকে কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করাও সরকারেরই দায়িত্ব। তবে এখন দেশে যেভাবে সকল পর্যায়ের মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশজ, জাতীয় এবং মাথাপিছু আয় যেভাবে বেড়ে চলেছে তাবে সব মানুষের ক্রম ক্ষমতা বেড়েছে। কাজেই এখন কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এখন সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ।
আর এবারের বাজেটে কৃষিখাতে এসব বিষয়কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছরের ন্যায় এবারো বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
সরকারের কৃষি নীতিতে প্রতিবছর ধানের মৌসুম শেষে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান ও চাল ক্রয় করার বিধান রয়েছে। সেই ক্রয়কৃত ধান-চাল জেলা-উপজেলায় নির্ধারিত সরকারি খাদ্যগুদামগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। দেশের যেকোন দৈব দুর্বিপাক অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সেসব সংরক্ষিত খাদ্য বিতরণ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ভিজিডি, ভিজিএফ, খোলা বাজারে (ওএমএস) বিক্রিসহ সরকারি বিভিন্ন রিলিফ কার্যক্রমে তা দেওয়া হয়। কিন্তু এবছর দেশে তেমন কোন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়ার কারণে সেসব গুদামে সংরক্ষিত খাদ্যগুলো গুদামেই থেকে গেছে।
সেজন্য এবছর খাদ্য সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল সরকারের পক্ষে নির্ধিারিত সময়ে কেনা হয়ে উঠেনি। তাছাড়া সরকারি নীতিতে চাল ক্রয়ের বিষয়টি কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা সম্ভব হয়ে উঠে না। সেজন্য চাল ক্রয়ের জন্য মিল মালিকদের উপর নির্ভর করতে হয়। সেক্ষেত্রে মিল মালিকেরা কৃষকের জন্য মহাজন এবং মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে অবতীর্ণ হয়। সেজন্য কৃষক, কৃষি সংগঠন এবং পলিসি লেবেল থেকে দাবী উঠেছে যাতে যেকোন মূল্যে যেন সরকারি ক্রয়কার্যটি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই করা হয় এবং তা নির্ধারিত সময়েই অর্থাৎ ভরা মৌসুমেই যেন করা হয়ে থাকে। সেজন্য কৃষিবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বাজেটের পূর্বে নির্ধারিত সাড়ে ১২ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্যেরে অতিরিক্ত আরো ৪ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয়ের বিষয়টি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আর সে মোতাবেক বাজেটে বরাদ্দও রেখেছেন। আগামী বছরগুলোতেও যাতে এ ধারা অব্যাহত রাখা যায় সেজন্য ধান-চাল ক্রয় নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাইলো ও গুদাম নির্মাণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের জন্য যে পরিমাণ ভর্তুকি প্রদান করা হয়ে থাকে সেটিতো অব্যাহত থাকবেই পাশাপাশি তা আরো বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষিকে অধুনিকীকরণের জন্য অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন স্বয়ংক্রিয় শস্য কর্তন যন্ত্র, ট্রাক্টর, শ্যালো টিউবওয়েল, রোপনযন্ত্র, সেচযন্ত্র ইত্যাদির উপর ব্যাপক হারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষকের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা যাতে কৃষকের উৎপাদন খরচও কমে এবং শ্রমিক না পাওয়া যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে কৃষিপণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে শুধু ধান চাষ না করে অন্যান্য লাভজনক ও উচ্চমূল্য ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। তাতে যেসব দেশে ধান-চাল রপ্তানির সুযোগ নেই সেসব দেশে অন্যান্য ফসল রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেমন আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ সপ্তম। অথচ উৎপাদন মৌসুমে আলুর দাম খুব কম থাকে এবং তখন তা অনেক নষ্ট হয়ে যায়। আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, পেয়ারাসহ অনেক ফল রয়েছে যেগুলো দেশের বাইরে অনেক সুনাম ও চাহিদা রয়েছে। সেগুলোর বাজার খঁজে খুঁজে রপ্তানির জন্য বিশেষ রপ্তানি অঞ্চলে প্রসেস করে যাতে প্রেরণ করা যায় সেজন্য ব্যবস্থা করছেন বলে বাজেট পরবর্তী বক্তৃতায় বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক উল্লেখ করেছেন। এভাবে কৃষিপণ্যের কৃষি বাণিজিকীকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। সেজন্য ভালোভাবে সবজি উৎপাদন করে তা উচ্চমূল্য কৃষিপণ্য হিসেবে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বাজেটে সুযোগ রাখা হয়েছে।
শুধু তাই নয় দক্ষ কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যেমন এক সময় উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকে চিরবিদায় জানানো গেছে ঠিক সেভাবেই হাওরাঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা মোকাবেলা করার জন্য কৃষি গবেষণার উপর জোর দিতে বাজেটে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ যেহেতু একটি কৃষি প্রধান দেশ সেকারণে দেশের গ্রামীণ উন্নতির জন্য কৃষি উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাছাড়া বর্তমান সরকারের অপর একটি শ্লোগান হলো ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’। অর্থাৎ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করেই দেশের গ্রামাঞ্চলকে শহরের সুবিধায় অগ্রগামী করা সম্ভব। গ্রামকে শহরের সুযোগ সুবিধায় ভরিয়ে দিতে হলে গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই শুধু কৃষি বাজেটেই নয় বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি, সামাজিক নিরাপত্তা, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, পরিবহন ও যোগাযোগ ইত্যাদি অনেক খাতে বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে যাতে সেগুলো কৃষি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
সেজন্য দেখা যাবে কৃষিখাতে যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রকৃত অর্থে সেটিই শুধু কৃষি বাজেট তাই নয়। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়েও কৃষি বাজেটকেই সমৃদ্ধ করা হয়ে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপকাভোগী আমাদের কৃষককুল এবং এক কথায় গ্রামীণ জনপদ। কাজেই বাজেট ঘোষিত হওয়ার পরে যার যত বক্তব্যই থাকুক না কেন সেটি আসলে পরিণতি পাবে জনকল্যাণে বাস্তবায়িত হওয়ার পর। আর আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি আওয়ামীলীগ সরকার তার কৃষি বাজেট বাস্তবায়নে সর্বদাই সিদ্ধহস্ত। আশাকরি এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না। কাজেই বাজেট ২০১৯-২০ এর কৃষি বরাদ্দের সঠিক বাস্তবায়ন ও সাফল্য কামনা করি।
লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম