Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

রেস্টেুরেন্ট কর্মী থেকে যেভাবে মার্কিন কোম্পানির কর্তা হলেন সাইফ

শাহনাজ পারভীন এলিস

প্রকাশিত: ১২:২৪, ৪ জানুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৬:৫৫, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রিন্ট:

রেস্টেুরেন্ট কর্মী থেকে যেভাবে মার্কিন কোম্পানির কর্তা হলেন সাইফ

-এ এইচ এম সাইফ হোসেন

রেস্টেুরেন্ট হোস্ট থেকে নিরন্তর চেষ্টায় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রিয়েল এস্টেট সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সিবিআরই-এর আঞ্চলিক প্রধান (রিজিওনাল হেড) হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের এ এইচ এম সাইফ হোসেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর এই রোমাঞ্চকর স্বপ্ন জয়ের গল্প শুনিয়েছেন বহুমাত্রিক.কম-কে। কথা বলেছেন শাহনাজ পারভীন এলিস-

‘গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই আমি বাবাকে হারাই। তখন আমার মনে হয়েছে যেভাবেই হোক পরিবারের পাশে, বিশেষ করে মায়ের পাশে আমাকে দাঁড়াতে হবে। কারণ আমিই পরিবারের বড় ছেলে। প্রথম কর্মজীবন শুরু করি গুলশানের একটি রেস্টুরেটের হোস্ট হিসেবে। এরপর নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করছি’-বহুমাত্রিক এর সাথে আলাপকালে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন এ এইচ এম সাইফ হোসেন।

সিবিআরই সম্পর্কে জানতে চাইলে সাইফ হোসেন বলেন, ‘এটি হলো অ্যামেরিকান একটি কোম্পানি। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রিয়েল এস্টেট সার্ভিস প্রতিষ্ঠান; যার বাৎসরিক আয় ৩০ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি বিশ্বের বৃহৎ আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশেও অপারেশন শুরু করেছে; যার প্রতিনিধিত্ব করছি। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। দেশীয় রিয়েল এস্টেট সেক্টরের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে কাজ করছি। এজন্য ভীষণ গর্ব বোধ করছি।’

সাইফ জানান, তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করলেও আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে তার কাজের এরিয়া এখন এশিয়া প্যাসিফিকের অন্তত ১৭টি দেশে বিস্তৃত। তাই এশিয়ার এসব অঞ্চলের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্ট্র্যাটেজি ও পলিসি নির্ধারণে তিনি ভূমিকা রাখছেন। কারণ ফরচুন ফাইভ হানড্রেড তালিকায় থাকা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান সিবিআরই। এর আগে তিনি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি বাংলালিংকের অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার এবং স্ট্যান্ডার্ন্ড চার্টার্ড ব্যাংকে রিজিওনাল হেড (সাউথ এশিয়া) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

সাইফ হোসেন জানান, খুবই সাধারণ একটি কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও কখনো মনোবল হারাননি। আত্মবিশ্বাস, মেধা ও একাগ্রতা থাকলে যে কোন অবস্থান থেকেই যে টপ লেভেলে পৌঁছানো যায়, তরুণদের জন্য তিনি সেই উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

কর্মজীবন কীভাবে শুরু জানতে চাইলে সাইফ বলেন, “গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই আমার বাবা মারা যান; তিনি উপসচিব ছিলেন। এরপর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গুলশান-২ এর ‘খানা-খাজানা’ নামে একটি রেস্টুরেটে হোস্টের কাজে যোগদান করি। বেতন মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আমার ইচ্ছা ছিলো কিছু একটা করার, তবে স্কোপ ছিলো না। দু’বছর পর সেখান থেকে ‘নানদোজ’ নামে অপর একটি রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করি এবং সেখান থেকে দু’মাসের ট্রেনিং নিতে নানদোজের হেড অফিস সাউথ আফ্রিকার জোহনেসবার্গে যাই। ২০০৭ সালে দেশে ফিরে টেলিকম প্রতিষ্ঠান বাংলালিংকে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজের সুযোগ পাই। সেখানে সাত বছরে ৭টি প্রমোশন পাই এবং পারফরম্যান্সের জন্য ৪ বার আউটস্ট্যান্ডিং অ্যাওয়ার্ড অর্জন করি।

২০১৩ সালের মার্চে সুযোগ আসে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ট ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে কাজ করার। সেখানে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় উচ্চতর ট্রেনিং নিতে ফিলিপাইনে যাই। ২০১৮ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ট গ্রুপ চেয়ারম্যান রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করি। এরপর পদোন্নতি পেয়ে ওই ব্যাংকের রিজিওনাল হেড (সাউথ এশিয়া) হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পরের বছর সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রিয়েল এস্টেট সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সিবিআরই-এর আঞ্চলিক প্রধান (রিজিওনাল হেড) হিসেবে যোগদান করি। সেখাসে প্রথম দিকে ১১টি দেশের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু হলেও, পরে তা বিস্তৃত হয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৭টি দেশে। এভাবে আমার স্বপ্নের গণ্ডি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কাজ করতে গিয়ে ছোট ছোট অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন জনের সহায়তা আর নিজের চেষ্টায় ধীরে ধীরে আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছি।”

কাজ করার মনোবল কোথা থেকে পেয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রেরণা আমার মা। তিনি ছিলেন দেয়ালের মতো। আমার বাবা খুব সৎ অফিসার ছিলেন। তিনি থাকা অবস্থায় আমাদের সামাজিক অবস্থান অনেক ভালো ছিলো। তিনি মারা যাওয়ার পর আমাদের পৃথিবী বদলে যেতে থাকে। মায়ের সাথে ছোট দুই ভাই-বোনের অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হয়। তবে বাবা অসুস্থ থাকা অবস্থায় মাকে কিছু গাইডলাইন দিয়ে গিয়েছিলেন; যেগুলো মা এবং আমি মেনে চলার চেষ্টা করেছি।’

সাইফ আরও বলেন, ‘যে কোন পর্যায়ের মানুষের সাথে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। তাদের কাছ থেকে শিখতে চাই। আমি যতটুকু জানি সেটা অন্যদের শেয়ার করতে চাই। কারণ আমার যতটা কষ্ট হয়েছে শিখতে, এ পর্যায়ে আসতে- তা যেন অন্যদের জন্য কিছুটা হলেও সহজ হয়। তবে শুরুতে আমার বড় কোন প্ল্যান ছিলো না। ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমান কাজ এবং দায়িত্বকেই সবসময় বেশি প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করি।’

বিভিন্ন দেশে কাজ করার চ্যালেঞ্জ ও অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে সাইফ বলেন, `একজন বাঙালি হিসেবে বহির্বিশ্বে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কমিউনিকেশন স্কিলের দুর্বলতা। আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে বেশিরভাগ মানুষের। আমি মনে করি, এ বিষয়ে আরও বেশি কাজ করা দরকার। কারণ আমি কী জানি তা যদি অন্যকে বলতে ও বোঝাতে সক্ষম না হই, তাহলে ভালো কিছু করা বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।` সাইফ জানান, ছোটবেলা থেকেই বাগান করা তার শখ। এজন্য ২০১৪ সালে উত্তরায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফাউন্ডার প্ল্যান্ট লাভারস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

সাইফ আপনি সিবিআরই-এর শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তাই শুধু নন; সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ‘ফুড অ্যাড ফ্লেভার্স’এর প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তা কীভাবে এলো- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফুড অ্যাড ফ্লেভার্স মূলত এদেশের প্রথম ও একমাত্র মিল কিড কোম্পানি। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি থেকে মিল কিড বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যানারে আমরা বিভিন্ন ধরনের খাবারের রেসিপি ও রান্নার উপকরণ সরবরাহ করে থাকি। বর্তমানে ৩১টি রেসিপি সরবরাহ চলমান থাকলেও পর্যায়ক্রমে আমরা ২শ’ রকমের খাবারের রেসিপি সরবরাহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর উদ্দেশ্য হলো- খাবার তৈরিতে সময়ের সাশ্রয়, একঘেয়েমি দূর করা। তিনি জানান, বাজারে চলমান কমার্শিয়াল খাবারে যেসব ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ ও আর্টিফিশিয়াল রঙ ব্যবহার করা হয়, মিল কিডের রেসিপিতে সেসব ব্যবহার করা হয় না। সেন্ট্রাল কিচেন ব্যবস্থাপনায় রেসিপিগুলোর গুণগতমান নিশ্চিত করা হয়। ফলে খাবারের গুণগণ মান নষ্ট হয় না, ফলে তা স্বাস্থ্যের জন্যও নিরাপদ।

একজন সফল উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য তরুণদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী জানতে চাইলে সাইফ বলেন, ‘আমি এখনো সফল নই, সফল হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে প্রত্যেরই ব্যবসা করা উচিত। তবে সাফল্য দ্রুত আসে না, সময় লাগে; ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতে হয়। কারণ ব্যবসা করেন নিজের পাশাপাশি পরিবার এবং সমাজের জন্য অনেকভাবে সহযোগিতা করার সুযোগ থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।’
সিবিআরই-এর আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে সাইফ বলেন- গ্লোবাল মার্কেটে দেশের অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করতে হলে নিজের কালচারাল অ্যাওয়ারনেস বাড়ানো জরুরি অত্যন্ত জরুরি। কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির আলাদা। নিজের মতো করে ভাবলে হবে না, কমিউনিকেশন স্কিল বাড়াতে হবে। তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শেখার মাসিকতাও থাকতে হবে।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের দেশের এ প্রজন্মের বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাই আগামীতে এই তরুণরা যোগ্যতার সাথে যোগ্য নেতৃত্ব দেবে, তাদের জন্য দরকার সঠিক গাইডলাইন। তরুণদের জানতে হবে আমাদের দেশের আইডল কারা, জীবনে সাফল্য পেতে কী ধরনের অভিজ্ঞতা ও ধর্য্যের মধ্য দিয়ে কঠিন পথ তাদের অতিক্রম করতে হয়েছে- সেসব বিষয় জানার আগ্রহ থাকতে হবে।

এদেশের মেধাবি ও অভিজ্ঞ অনেক তরুণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যায়; সেখানে গিয়ে তারা ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করেন- এই বিষয়কে আপনি কীভাবে দেখেন? সাইফ বলেন, আমি মনে করি মেধাকে এক স্থানে রেখে দেয়ার মাঝে কোন স্বার্থকতা নেই; বরং মেধাবী তরুণদের জন্য গ্লোবাল মার্কেট সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি করা জরুরি। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ, তা যেখানেই হোক অসুবিধা নেই। ক্যারিয়ার গড়তে ভিন দেশে গিয়ে কোন তরুণ যদি কাজের পাশাপাশি তার নিজের দেশকে ধারণ করে, দেশের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারে- কোন অসুবিধা নেই। কারণ তিনি ওখানে থেকেও এদেশের জন্য কিছু করা যায় কিনা সে চেষ্টাই করবেন। এতে বিশ্ব দরবারে দেশের সুনাম অর্জনে ভূমিকা তিনি রাখছেন।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer