Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

হারিয়ে যেতে বসেছে রাজা হরিশ চন্দ্রের প্রাসাদ ঢিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৪:৪৮, ১১ জানুয়ারি ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

হারিয়ে যেতে বসেছে রাজা হরিশ চন্দ্রের প্রাসাদ ঢিবি

সাভার : সাভারের পূর্ব নাম ছিল সম্ভার। সম্ভার অর্থাৎ সাভার নগরীতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ শাসকদের মধ্যে রাজা হরিশ চন্দ্রের নাম উল্লেখযোগ্য।

আর রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজধানী হচ্ছে সাভার। পৌর এলাকার রাজাশন মহল্লায় ছিল রাজা হরিশ চন্দ্রের রাজবাড়ি। যা বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষণে থাকলেও রাজার শেষকীর্তি রয়েছে অবহেলিত। যার সিংহভাগই বেদখল হয়ে গেছে।

স্থানীয় প্রভাবশালী মহল হরিশ চন্দ্রের ভূ-সম্পত্তি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে রেখেছে। অনেকে নির্মাণ করছে ভবন। তাছাড়া প্রায় এক একর জমির মধ্যে ১০ থেকে ১২ টি প্লট বানিয়ে তা অন্যত্র বিক্রি করেছে ওই প্রভাবশালী মহল।

ইতিহাস থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও তার অধীনস্থ্য নায়েবরা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। সে সময় বেশিভাগ রাজ প্রাসাদ ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে প্রচলন ছিল। কালের বিবর্তনে সে সব রাজবংশের রাজত্বের অবসান ঘটেছে। কিন্তু আজও অনেক স্থানে সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে তাদের অনেক স্থাপত্য এবং সম্পদ। আমাদের দেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এসব স্থাপত্য কিছু কিছু দেখা গেলেও পরে আর তেমন হদিস পাওয়া যায়নি। তেমন একজন ছিলেন সাভার অঞ্চলে রাজা হরিশ চন্দ্র। ময়নামতির তান্ত্রিক মহারানীর পুত্র গোপীনাথের সঙ্গে রাজা হরিশ চন্দ্রের জ্যেষ্ঠ কন্যা অনু দা’র বিয়ে এবং কনিষ্ঠ কন্যা পদুনাকে যৌতুক প্রদানের কাহিনী বিজড়িত এ হরিশ চন্দ্রের ঢিবি।

তৎকালীন ভারত বর্ষে এ দেশে ঐতিহ্যের নিদর্শন খুঁজে বের করতে কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে ছিলেন। সে সময় অনেক জায়গায় ইতিহাসের নামকরা রাজা-মহারাজাদের প্রাসাদ নির্দিষ্ট করে ছিলেন। যার মধ্যে বার ভূঁইয়ার ঈশা খাঁর আজকের সোনারগাঁ। এরও অনেক পরে বের হয়ে আসে ঢাকার অদূরে সাভারে রাজা হরিশ চন্দ্রের প্রাসাদ।

কিন্তু এরপর আর খোঁজ নেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে সে হারানো ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব নির্দশন পুনরুদ্ধার করতে দেশের প্রত্নতত্ত্ববিদরা তৎপর হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে সাভারের রাজাশন এলাকায় ১৯৮৮-১৯৯০ সালে ২টি ঢিবির সন্ধান পায়। যা ইতিহাস থেকে নির্দিষ্ট করা ‘রাজা হরিশ চন্দ্রের প্রাসাদ ঢিবি’ হিসেবে। একটি রাজাশন এলাকার মজিদপুরের আম তলায় ‘রাজা হরিশ চন্দ্রের প্রাসাদ ঢিবি’ এবং আরেকটি ডগড়মোরা এলাকায় ‘রাজা হরিশ চন্দ্রের বুরুজ’ নামে পরিচিতি পায়।

যা পরে সরকার এসব জমি অধিগ্রহণ করে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। ঢিবিতে অনুসন্ধান করে ১টি স্তূপসহ একটি বিহারের ধ্বংসাবশেষ এখানে অনাবৃত রয়েছে। বিহারটি ৩৯ দশমিক ৯৭ বর্গমিটার প্রশস্থ এবং স্তুপটি ১৭ বর্গমিটার প্রশস্থ বলে সাবস্ত করা হয়। এর ১৫০ মিটার পূর্বদিকে রাজাশন নামে আরও একটি ঢিবি রয়েছে। যা এখনো সম্পূর্ণরূপে খনন হয়নি। এ দুটি প্রত্নস্থল থেকে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য খচিত পোড়ামাটির টুকরো, ব্রোঞ্জের তৈরি মুদ্রাকার বৌদ্ধ মূর্তি, বিভিন্ন টেরাকোটা এবং গুপ্ত অবস্থায় লুকায়িত নকল স্বর্ণ মুদ্রাও আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-লোকেশ্বর, অবকিতেশ্বর, ভূমিস্পর্শ মুদ্রার ধ্যানি বুদ্ধ, জম্মুন, জমল ও অভয় মুদ্রার ধ্যানি বুদ্ধমূর্তি। যা পরে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের মাধ্যমে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানা গেছে।

রাজাশন মৌজার ৫ দশমিক ৬০ একর ভূমি ১৯২০ সালের ২০শে নভেম্বর এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বৃটিশ সরকার সংরক্ষিত পূরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯২৬ সালের ২০শে মার্চ বর্ণিত ভূমি পূরাকীর্তি হুকুমদখল করে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু স্থানীয় ভুমিদস্যু রাজা হরিশ চন্দ্রের এই ভূ-সম্পত্তির সিংহভাগই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে। এমনকি কিছু অংশ বিক্রিও করে দেয়। সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ও সরকারী হুকুম দখলকৃত রাজাশন ঢিবির উপর বে-আইনীভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মো: শফিকুল আলম স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র ২০০৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী অফিসারসহ একাধিক সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে দাখিল করেন।

তিনি তখন তার অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করেছিলেন, রাজাশন মৌজার আরএস খতিয়ান নং-১৩৯, ১৪০ এর দাগ নং-১৬, ১৭, ১৮-এর ৫ দশমিক ৬০ একর ভুমিতে অবস্থিত একটি প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসবিশেষ বৃটিশ সরকার কর্তৃক ১৯২০ সালে সংরক্ষিত পূরাকীর্তি হিসেবে ঘোষনা করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত ভূমি ১৯২৫ ও ১৯২৬ সালে এলএ কেসের (নং-১২) মাধ্যমে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুকুলে হুকুম দখল করা হয়।

বর্তমানে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জমি দখল প্রক্রিয়া চালায়। এছাড়া সংরক্ষিত পূরার্কীতি স্থানটি মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসীদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে।

গত কয়েক দশকে এ এলাকায় জমির মূল্য বেড়ে কয়েক গুণ হয়েছে। স্থানীয় ভূমিদস্যু এসব প্রতœতত্ত্ব নিদর্শনের জমি দখল করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।
ডগরমোড়া মৌজার জেএল নং- সিএস-৬৫২, এসএ-১৬৩, প্লট নং যথাক্রমে সিএস দাগ ১০ এর .৩৬ শতাংশ এবং সিএস দাগ ১২ আংশিক .০৬ শতাংশ। মোট .৪২ শতাংশ ভূমি ‘রাজা হরিশ চন্দ্রের বুরুজ’ হিসেবে পরিচিত। এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতœনিদর্শন ১৯৮৭ সালে সরকার সংরক্ষিত প্রাচীনর্কীতি হিসেবে ঘোষণা করে। আর এর রক্ষনা-বেক্ষনের দায়িত্বে সরকার তথা প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। ওই আদেশের ১৯ ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত পূরার্কীতির কোনরুপ ক্ষতিসাধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন আইনের পরিপন্থি উল্লেখ থাকলেও দখলকারীরা কোন কর্নপাত না করে নির্দিধায় দখল প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।

ঐতিয্যবাহী এ নির্দশনের চারদিকে নোংরা আবর্জনায় এ নির্দশনগুলো যেন ডাস্টবিনের মতো মনে হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক জানান, এভাবে চলতে থাকলে এক সময় হারিয়ে যাবে এ ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। তার মতে, সরকারি হস্তক্ষেপে এখনই ব্যবস্থা না নিলে নতুন প্রজন্মের কাছে কাল্পনিক ইতিহাসে পরিণত হতে পারে রাজা হরিশ চন্দ্রের ঐতিয্যবাহী এ প্রাসাদ। তিনি বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সদিচ্ছার অভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে সাভারের রাজা হরিশ চন্দ্রের ঐতিয্য নির্দশন।

এব্যপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক মো: আলতাব হোসেন জানান, দখল হওয়া সম্পত্তিগুলো যে আমাদের তা সত্যতা প্রকাশের মামলা চলমান রয়েছে। আর হরিশ চন্দ্র রাজার প্রসাদ ঢিবি রক্ষার্থে শুধু সরকার নয় সরকারের পাশা-পাশি সাভারের সাধারন মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer