রাঙ্গামাটি : ১৮ জুলাই ছিল বৃহত্তম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্য এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদের সংসদ সুদীপ্তা দেওয়ানের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্নেহভাজন প্রয়াত এই সংসদ সদস্য ২০১৫ সালের এই দিনে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নে আত্ম নিবেদিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ অনুসারী আওয়ামী লীগের প্রয়াত এই নেতা। প্রয়াত এই সংসদ সদস্যের দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। প্রয়াত এই নেত্রীর দ্বিতীয় বার্ষিকীতে বড় ধরনের শোক শোভার আয়োজনের আয়োজন দেখা না গেলেও রাঙ্গামাটির অসংখ্য লোকজনের মনে শ্রদ্ধার আসনে ঠিকই আসীন রয়েছেন এই নেত্রী।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী প্রয়াত সংসদ সদস্য সুদীপ্তা দেওয়ান চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের সভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ২০ জানুয়ারী। তাঁর পিতা প্রসন্ন কুমার বিশ্বাস ও মাতা সাবিত্রী বিশ্বাসের সাত ছেলে মেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সুদীপ্তা দেওয়োন। তাঁর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একভাই মনিভূষন বিশ্বাস ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মাস্টার দা সূর্যসেনের অনুসারী হিসেবে আেেন্দালন করে কারাবন্দী হয়েছিলেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর বোমা হামলায় প্রসন্ন কুমার বিশ্বাসের সুলতান পুরের বসতবাড়ি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তদান্তীন পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুন ও বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ এ.কে দেওয়ানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন ১৯৫৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। স্বামীর আবাসস্থল রাঙ্গামাটি হওয়ার সুবাদে তাঁর সাংসারিক জীবন শুরু হয় রাঙ্গামাটিতে। পরবর্তীতে রাঙ্গামাটি জেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হোন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী এই সাংসদ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতৃবুন্দের কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। জাতির জনকের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শ্রদ্ধা করতেন সুদীপ্তা দেওয়ানকে। ১৯৯০ সালে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচত পর ১৯৯১ সালে রাঙ্গামাটি সফরকালে সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাঙ্গামাটির সুদীপ্তা দেওয়ানের বাসভবনে গিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সংরক্ষিত আসনে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম হতে (মহিলা আসন-১৫) সুদীপ্তা দেওয়ানকে মনোনিত করেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে স্নেহধন্য এই সাংসদ ১৯৭৩ সাল হতে জাতির জনকের শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে এক যোগে কাজে করেছেন।
১৯৭৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক চারু বিকাশ চাকমা সহ উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি প্রশাসনিক এলাকায় পরিনত করা সহ এখানকার উপজাতীয় গোষ্ঠীর জাতিগত বৈশিষ্ট, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য আহ্বান জানান। এই প্রতিনিধি দলের আহ্বানের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু নির্বাহী আদেশ বলে পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০ সাল বলবৎ করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা সংরক্ষন এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মূখ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন তদান্তরীণ সংসদ সদস্য সুদীপ্তা দেওয়ান। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ২০টি উপজাতীয় কোটা সংরক্ষণের প্রস্তাবনা করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধূ উপজাতীয় ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৩টি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ২টি, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩টি, কৃষি কলেজে ২টি ও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ৫টি আসন সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। সে সময় চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অবস্ঞানরত উপজাতীয় শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য দুটি ভবন (পরিত্যক্ত বাড়ি) বরাদ্দের বিষয়েও তিনি মূখ্য ভুমিকা পালন করেন। রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়কে ১৯৭৪ সালে সরকারি বিদ্যালয়ে পরিণত করার ক্ষেত্রেও মূল্যবান ভূমিকা রাখেন এই সাংসদ।
শিক্ষার উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ধর্মীয় উন্নয়নেও প্রয়াত সাংসদ সুদীপ্তা দেওয়ান তাঁর স্বল্পকালীন দায়িত্বের সময়ে কাজ করেছেন। সাধক পুরুষ বনভান্তের সাধনার পবিত্র স্থান মগবান ইউনিয়নের ধনপাতা গ্রামের মোরঘোনা এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়লে পরবর্তীতে বনভান্তের নতুন সাধনাস্থল লংগদুর তিনটিলা এলাকায় বনবিহার মন্দির স্থাপনে সুদীপ্তা দেওয়ান বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ জানালে সেসময় বঙ্গবন্ধু তিনটিলা বন বিহার মন্দির নির্মাণে ৫ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন।
১৯৭৩ সালের ৫ নভেম্বর তিনটিলা বন বিহারে ঐতিহাসিক কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান এ উপস্থিত ছিলেন এই সাংসদ নিজেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেও তিনি ছিলেন সমান সক্রিয়অ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম কুটির শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এখানে যে কুটির শিল্পের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন সেই কুটির শিল্প পরিচালনার জন্য (বাংলাদেশ কটেজ ইন্ড্রাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) খন্ডকালীন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুদীপ্তা দেওয়ান।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে আজ যেসব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার অনেক কিছুর স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রয়াত এই সাংসদ। ১৯৭৩ সালের ২ জুলাই মহান জাতীয় মংমদে; ১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট অধিবেশনে সুদীপ্তা দেওয়ানের বক্তব্য সেই স্বপ্ন দেখার বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করে। তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অহ্ছলের দুর্গমতার কথা বিবেচনা করে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ বার্যক্রম গ্রহণসহ এখানকার শিক্ষার উন্নয়নে বরাদ্দ এবং তিন পার্বত্য জেলার বালিকা স্কুলের সংকটের কথা তুলে ধরেন।
সেই বক্তব্যে সুদীপ্তা দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলকে একটি পর্যটন অঞ্চল হিসেবে গঢ়ে তোলা সহ এখানে সরকারি উদ্যোগে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের আহ্বান জানান। পার্বত্য অঞ্চলে কৃষির উন্নয়নে এখানে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণসহ কৃষির উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি হিমাগার এবং একটি ক্যানিং ফ্যাক্টরি স্থাপনের আহ্বান জানান। শুধু তাই নয়,তিনি তাঁর সেই দিনের বাজেট বক্তৃতায় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের আহ্বান জানান।
রাজনীতিবিদ হিসেবে সফলতার পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রয়াত সুদীপ্তা দেওয়ান সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে গার্লস গাইড আন্দোলন অন্যান্য সামাজিক ও জনহিতকর আন্দোলনেও তিনি সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন। মিষ্টভাষী এই রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী নব্বই দশক পর্যন্ত সকল কাজে সক্রিয় থাকলেও ২০০৪ সালে এসে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে সকল কাজ থেকে কিছুটা দূরে সরে পড়েন। দেশ বিদেশে অনেক চিকিৎসার পরও তাঁর দৃষ্টি ফিরে না আসায় কিছুটা শ্লথ পড়ে কর্ম তৎপর এই সাবেক সাংসদ। পরবর্তীতে কিডনী জটিলতার কারণে তাকে জীবনের শেষ সময়ে সার্বক্ষণিক চিকিৎসার জন্য ঢাকায় অবস্থান করতে হয়। ঢাকায় অবস্থান কালীন সময়ে ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় ঘটে এই মহিয়সী নারীর। পরবর্তীতে তাঁর মৃত দেহ রাঙ্গামাটিতে নিয়ে আসার পর সর্বস্তরের জনগণের অকৃত্রিম শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে আসামবস্তি মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী প্রয়াত সাবেক সাংসদ সুদীপ্তা দেওয়ানকে ২০০১ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব ফেডারেশনসহ আরো একাধিক জাতীয় ও স্থানীয় সংগঠনের পক্ষ হতে বিভিন্ন পদকে ভূষিত হোন তিনি। তবে আরো অনেক সম্মাননার দাবীদার ছিলেন এই মহিয়সী রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী এই সাবেক সাংসদ। ভবিষ্যতে হলেও প্রয়াত সুদীপ্তা দেওয়ানকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হবে বলে আশাবাদী তাঁর পরিবারের সদস্যগণ।
রাজনীতি এবং সামাজিক জীবনে সফল এই সাবেক সাংসদ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও ছিলেন সমান সফল একজন নারী। তাঁর তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসহ জামাতারা সকলে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং উচ্চ শিক্ষিত। স্বামী বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ এ.কে দেওয়ান এখনো চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে সক্রিয়। প্রয়াত সুদীপ্তা দেওয়ানের স্বামী ডাঃ এ কে দেওয়ান এর সংগ্রহে এখনো সুদীপ্তা দেওয়ানের সংসদ থাকাকালীন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন চিঠি পত্র সংরক্ষিত আছে। তার এই সংগ্রহ শালা থেকে দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সময় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে তিনি এমন অনেক কাজ করেছিলেন যা কখনো তিনি প্রকাশ করেননি। সেই সময় তাঁর কাছে লিখা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একাধিক অনুরোধপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কোন প্রকার প্রচারনাকে প্রাধান্য না দিয়ে তিনি কতটা নীরবে এখানকার অনেকের উপকার করে গেছেন।
সদালপী,পরোপকারী, সজ্জন প্রয়াত এই সংসদ সদস্য সুদীপ্তা দেওয়ান তাঁর কীর্তিময় কর্মকান্ডের কারণে রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্যবাসীর নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও অধ্যক্ষ, রাঙ্গামাটি শিশু নিকেতন।
বহুমাত্রিক.কম