ছবি : সংগৃহীত
গাজীপুর : চিরন্তন সত্য মৃত্যুর খবর মাত্রই বিয়োগান্তক-শোকের। প্রতিদিনই তো কত মৃত্যু আর নবজন্মের খবর থাকে। অতি আপন বা খুব কাছের কেউ না হলে তেমন রেখাপাত করে না। ফটো সাংবাদিক ডাবলিউ রহমানের মৃত্যুর খবরটা সহকর্মী হিসেবে বেদনাদায়ক।
কিন্তু তাকে জীবিতকালে মূল্যায়ন না করতে পারার বিবেক যন্ত্রণা কোনদিন ক্ষমা করবে না। যতটা অবহেলায় দেখা হয় একজন মফস্বল ফটো সাংবাদিককে, তা যে ঠিক নয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে জানান দিলেন ডাবলিউ রহমান-আসলে কতটা মূল্যবান ছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর খবরটা দেখলাম ফেসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সহ জেলার রাজনীতিবিদ শীর্ষ নেতৃবৃন্দের শোক ও সমবেদনা জানানোর বিষয়টিও ঘটেছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়। কতটা সার্বজনীন ছিলেন ডাবলিউ রহমান বেঁচে থাকতে বুঝতে দিলেন না। মরেই প্রমাণ করতে হলো।
দেখলাম-এক রাজনীতিক ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘গাজীপুরের বড় বড় নেতাদের সব ভাল ভাল ছবিগুলো ডাবলিউ রহমানের তোলা।’ এই কথাটুকুর ভেতর ডাবলিউ রহমানের কর্মজীবনের মূল্যায়ন এসে যায়। কিন্তু দায়বদ্ধতা থেকে আর কিছু কথা জানাতেই হয়।
১৪ এপ্রিল ২০১৫। সকাল সাড়ে ৮টা। পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় অংশ নিতে গাজীপুর প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম। সেখানেই আমার-আমাদের অনেকের ছবি আলাদাভাবে বা একত্রে ক্যামেরাবন্দি করেন ডাবলিউ রহমান। অনেকদিন পর হঠাৎ ছবিগুলোর প্রিন্ট কপিও নিজ দায়িত্বে বুঝিয়েও দেন। এটাই তার বরাবরের অভ্যাস। এভাবেই অনেকেরই দূর্লভ মুহূর্ত-স্মৃতি ধরে রাখার অবদান আছে তাঁর।
গত মঙ্গলবার রাত বারটা গড়িয়ে বুধবার পড়েছে। অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি। শারীরিক প্রয়োজনে খুব জরুরি ছিল দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার। ওষুধ ব্যর্থ হবার পর আত্মসম্মোহন দিয়েও কাজ হলো না। ফেসবুক আসক্তিও তেমন নেই। রাত দেড়টার দিকে তাও সেখানেই ঢুঁ দিলাম। আর পেলাম শোক বার্তাখানি। বুকে চিনচিন-ব্যথা অনুভব করলাম। কেন?
ডাবলিউ রহমানের সঙ্গে সহকর্মীর মতই স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল সব সময়। তাও কেন তার মৃত্যু এভাবে নাড়া দিল ? কোথায় যেন একটা আত্মবঞ্চনার তাড়না বিবেকের আদালতে মাথা ঠুকছিল। কী করণীয় ছিল তার জন্য ? কিছুই তো করা হয়নি। অন্তত বেঁচে থাকতে তাকে নিয়ে দু’লাইন লিখলেও হতো! গাজীপুর পুলিশ সুপার অফিসে সংবাদ সম্মেলনে জেমএমবি সদস্য জাহিদের গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত ডাবলিউ রহমান আর কোনদিন সে দাবি জানাতে আসবেন না। কোনদিন আক্ষেপ করবেন না-কতজন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে বরাদ্দ পেলেন। আমি ডাবলিউ রহমান কেন সে ভাগ্য নিয়ে মরতে পারলাম না?
হায়! ডাবলিউ রহমান। চলে গেলেন। বলে গেলেন, আর কোনদিন তুলবেন না কোন ফটো সাংবাদিক ডাবলিউ রহমান। হঠাৎ দেখা হলে উচ্চস্বরে চিরচেনা ভঙ্গিতে আর সালাম বিনিময় করবেন না। হাতে ধরিয়ে দিবেন না ক্যামেরাবন্দি কোন বিস্মৃত দূর্লভ মুহূর্তের কথা বলা ছবি। কেবল আর কোন ছবি তুলবেন না। এই সত্যটিই বার বার জানিয়ে দিবেন-এত অবহেলিত এক মফস্বল ফটো সাংবাদিক তাঁর কর্মগুণ দিয়ে নিজেকে কতটা মূল্যবান করে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
হতে পারেন একজন মফস্বল ফটো সাংবাদিক। কর্ম দিয়েই মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন তিনি। ডাবলিউ রহমান, তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না। কিন্তু যাঁরা করতে পারতেন, করার দায়িত্ব ছিল যাঁদের; তাঁদের বিবেকের কাছে তোমার শেষ প্রশ্নটি রেখে গেলাম। আমি-আমরা সবাই এমনি একদিন চলে যাবো। বেঁচে থাকবে কর্ম। আর দায়িত্ব পালন না করতে পারার ‘বিবেক-দংশন’।
লেখক : কবি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
বহুমাত্রিক.কম