Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

চিনির প্রাকৃতিক বিকল্প ‘মধুপল্লব’

ড. আলিয়া মমতাজ

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ২৯ মে ২০১৪

আপডেট: ২৩:৫১, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

প্রিন্ট:

চিনির প্রাকৃতিক বিকল্প ‘মধুপল্লব’

যুক্তরাষ্ট্র থেকে: চিনি ছাড়া আমাদের জীবন- এ যেনো এক অসম্ভব কল্পনা। 

প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত যে চিনি (আখ, বিট থেকে প্রাপ্ত সুক্রোজ) আমরা খাই তা খুব দ্রুত এনজাইমের দ্বারা ডাইজেস্ট হয়ে বেশিরভাগই শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তি, কাজ মিটিয়ে ফেলে বাকীটা যকৃৎ-এ গিয়ে জমা হয়। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মানব দেহের জন্য। কিন্তু সমস্যা হয়, যখন মাত্রাটা আমরা ছাড়িয়ে যাই, কারন আমাদের জীবনটা এতটাই চিনিময় করে ফেলেছি যে সাম্প্রতিক সময়ে চিনি ছাড়া যেন আমাদের সারাদিন চলেই না, নাস্তা থেকে শুরু করে পানীয় সবকিছুতেই চিনি আর চিনি।

অতিরিক্ত চিনি ব্লাডস্ট্রিমে চলে এলে বেচারা প্যানক্রিয়াস, যকৃৎ পড়ে যায় বিপাকে কারণ এদেরও রয়েছে একটা সীমা । অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি, যকৃৎ-এ গ্লাইকোজেন এর ওভারলোডিং এবং ফল স্বরূপ অতিরিক্ত চর্বি তৈরি করতে হয় বাধ্য হয়েই। এবং সেই সাথে সৃষ্টি হয় নানাবিধ রোগ, যেমন টাইপ-২ ডায়াবেটিক থেকে হৃদরোগের মত কঠিন কঠিন রোগগুলো। এছাড়া আবার অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ইন্সুলিনের ওভার প্রডাকশন এর কারণে ক্যান্সারও নাকি বাসা বাঁধতে পারে শরীরে।

এখন দেখা যাক, চিনির বিকল্প কী হতে পারে।

aliyaচিনির বিকল্প হিসাবে অনেক কৃত্রিম সুইটেনার যেমন এস্পারটেম, স্যাকারিন, সুক্রালোজ ইত্যাদির ব্যবহার চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু গবেষণায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এগুলো ব্যবহারের ফলাফল মানুষের জন্য সুখকর নয় বিধায় মানুষ খুঁজে চলেছে প্রাকৃতিক কিছু। এবং আজকের এই আলোচনা সেই প্রাকৃতিক সুইটেনার ‘মধুপল্লব’ কে নিয়েই।
মধুপল্লব (Stevia rebaudiana) গুল্ম জাতীয় বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ । ন্যাচারাল সুইটেনার হিসাবে পরিচিত এ উদ্ভিদের আদি নিবাস দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় । ট্রপিকাল এবং সাবট্রপিকাল অঞ্চলেও এদের দেখা মেলে । এটি সূর্যমুখি পরিবার ভুক্ত (Asteraceae), স্টিভিয়া জেনাসের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ।

সুইটেনার ও মেডিসিনাল প্ল্যান্ট হিসাবে প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিলে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রায় ১০০ বছর ধরে। ভারতে একে ‘মধুপল্লব’ নামে ডাকা হয় এবং এখানে এর ব্যবহার রয়েছে প্রাচীন কাল থেকে। দক্ষিণ আমেরিকা বা অন্যান্য এলাকায় একে ‘ক্যান্ডিলিফ’ বলা হয়।

১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে সুইস উদ্ভিবিদ Moisés Santiago Bertoni পুর্ব প্যারাগুয়ে এই গাছটির প্রথম সন্ধান পান । তিনি এই গাছের বৈশিষ্ট্য ও এর মিষ্টতা নিয়ে প্রথম বর্ণনা করেন। তারপর, ১৯৩১ সালের আগ পর্যন্ত গাছটি নিয়ে কেউ খুব একটা বেশি আগ্রহ দেখান নি। ১৯৩১ সালে, একজন ফরাসি রসায়নবিদ মধুপল্লব বা স্টিভিয়া থেকে গ্লাইকোসাইড প্রথম আবিষ্কার করেন, যেটা মিষ্টতার জন্য দায়ী।

মধুপল্লবের পাতায় রয়েছে বিভিন্ন রকমের ডাইটারপিন গ্লাইকোসাইড। এদের মধ্যে stevioside, steviolbioside, rebaudiosides A-E, and dulcoside উল্লেখযোগ্য। গাছের প্রায় সবখানেই গ্লাইকোসাইড আছে তবে, পাতায় এর পরিমান বেশি। এই `গ্লাইকোসাইড` গুলোকে একত্রে Steviol glycoside বলা হয়। Aliya

সাধারণত সুইটেনার হিসাবে স্টেভিওসাইডস এবং রিবাউডিওসাইড (rebaudioside ) ব্যবহৃত হয়। মূলত পাতা থেকেই গ্লাইকোসাইডকে এক্সট্রাক্ট করা হয়। যেটা খাবার চিনি ‘সুক্রোস’ থেকে ৩৫ থেকে ৪০ গুন বেশি মিষ্টি এবং ক্যালরির পরিমাণ শুন্য। অর্থাৎ যেখানে আমরা ১গ্রাম সুক্রোস থেকে পেয়ে থাকি ৪ ক্যালরি, সেখানে স্টিভিয়া থেকে প্রাপ্ত ক্যালরি হবে শুন্য।

এটাতে ক্যালরির পরিমান ‘শুন্য’ তার কারণ হল এটি সুক্রোসের মত স্টোমাকে ডাইজেস্ট হয়ে ফ্রুক্টোজে পরিণত হয়ে ব্লাডস্ট্রিমে যেতে পারে না। কিন্তু আমাদের জিহ্বার টেস্ট বাড এর মিষ্টতা সনাক্ত করতে পারে, কারণ এদের গ্লাকোসাইডে রয়েছে এগ্লাইকোনের সাথে (নন সুগার) যুক্ত গ্লকোজ মলিকিউল। এই এগ্লাইকোন মলিকুল আবার অনেক সময় তিতা স্বাদের জন্য দায়ী। এবং এটা থেকে অন্যান্য সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটস সহ অন্য নিউট্রিয়েন্ট গুলোও পেতে পারি।
মধুপল্লবের প্রথম ব্যবহার শুরু হয় জাপানে ১৯৭১ সালে। জাপান এর Morita Kagaku Kogyo Co. Ltd এটার প্রথম ব্যবহার শুরু করেছিল বাণিজ্যিকভাবে ।

অনেক গবেষণার পর, এখন এটার বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার বহুল প্রচলিত এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই এর ব্যবহার অনুমোদন করেছে। এটি এখন নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন স্বল্প ক্যালরির খাদ্যদ্রব্য তে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন ফুড কোম্পানি তাদের ‘০’ ক্যালরি পানীয় তে এটার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ভোক্তাদের বেশ পছন্দীয়। পানীয় ছাড়াও যেকোন কেক, পাই বা যে কোন মিষ্টান্নতেও এই স্টিভিয়া ব্যবহার করা যায়।

স্টিভিওসাইড ও রিবাউডিসাইড ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটস যে গুলো মিষ্টতা`র সাথে অন্য শরীরের প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করে থাকে এবং আয়ুর্বেদিক দৃষ্টিকোণ হতে বিভিন্ন চর্ম রোগ, মুখের ঘা, পরিপাকতন্ত্রীয় সমস্যা নিরামায়ক , বিভিন্ন ক্ষত নিরাময় ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।
বিভিন্ন গ্রোসারি স্টোরেও এটি পাওয়া যায় পিওরভিয়া, স্টিভিয়া, সুইটলিফ, রিবিয়ানা, সানকৃস্টাল নামে।

আরো যা বলা প্রয়োজন

এই পোষ্টে পরিবেশিত আয়ুর্বেদিক তথ্যসমুহ প্রেসক্রিপশন হিসাবে গণ্য হবে না। এবং ওজন কমানোর জন্য চিনি খাওয়া ছেড়ে দিয়ে শুধু মধুপল্লবের উপর নির্ভর হলে আশানুরুপ ফলাফল নাও পাওয়া যেতে পারে।
"Caution is advised when using medications that may also lower blood sugar. People taking insulin or drugs for diabetes by mouth should be monitored closely by a qualified health care professional, including a pharmacist,"
কোন কিছুই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়, সুস্থ ও সবল দেহ রাখার জন্য নিয়ম মাফিক, পুষ্টিকর সবধরনের খাবার মডারেশন করে খেয়ে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করে অনায়াসে সুস্থ থাকা সম্ভব।


ALiya_Momomtazড. আলিয়া মমতাজ: উদ্ভিদ প্রজনন ও জীবপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বহুজাতিক খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। 

[email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer