কাওরাইদে রেলওয়ের সম্পদ হরিলুট, পরিত্যাক্ত কোয়ার্টারে মার্কেট

গাজীপুর : বাংলাদেশ রেলওয়ের সম্পদ লুটপাট ও জমি বেহাতের ঘটনা ঘটেছে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ এলাকায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের কাওরাইদ স্টেশনের সংস্কারাধীন এক নম্বর লাইনের ভাঙ্গা পাথর চড়ামূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া স্টেশন এলাকায় রেলওয়ের কর্মচারীদের পরিত্যাক্ত কোয়ার্টার ভেঙ্গে মার্কেট গড়ে তোলার ঘটনাও ঘটেছে। অন্যান্য রেল কর্মচারীদের যোগসাজশে কাওরাইদে রেলওয়ের মিস্ত্রি ও স্থানীয় বাসিন্দা মোসলেম উদ্দিন বাবু এ অপতৎপরতা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

স্থানীয় সুত্র এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরনো ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় কাওরাইদ রেলওয়ে স্টেশনের এক নম্বর লাইনটি উঠিয়ে নতুন করে লাইন বসানোর উদ্যোগ নেয় রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ। এ কাজ বাস্তবায়নকালে লাইনে থাকা পাথরের ভাঙ্গা অংশ মাটিসহ সরিয়ে পুনরায় লাইনে ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও রেলওয়ের মিস্ত্রি স্থানীয় কিছু ব্যক্তিদের সহযোগে স্টেশনের অদূরে ট্রাকে করে নিয়ে জড়ো করেন। সেখানে মাটি থেকে পাথরের টুকরা আলাদা করে বিক্রির জন্য জড়ো করতে থাকেন। সরেজমিন কাওরাইদের নূরানী ভিটা মধ্যপাড়ায় স্তুপাকারে রাখা রেলওয়ের এসব পাথরের অস্তিত্ব মেলে। চোখে পড়ে ভেকু দিয়ে মাটি থেকে পাথর পৃথককরণের দৃশ্যও।

স্থানীয় যুবক মানিক কিছু লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে রেলওয়ের এসব পাথর পাহারা দিচ্ছিলেন। ঘুরে দেখার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের তারা ভয়-ভীতি দেখান। এসময় পাথর রক্ষণাবেক্ষণকারী মানিক বলেন, ‘রেল মিস্ত্রি মোসলেম উদ্দিন বাবুসহ স্টেশন মাস্টার এবিষয়ে সব জানানে। আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দেখে রাখার।’

সংস্কারাধীন লাইনের পুরনো পাথর-স্লিপার সরিয়ে সিমেন্টের স্লিপার বসানো হয়েছে

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক যুবক জানান, ১০০-১২০ টাকা ফুট দরে বিক্রি করা হচ্ছে এসব পাথর। গত দুই তিন সপ্তাহ ধরে পাথর বিক্রির এই তৎপরতা চলছে। শুধু ভাঙ্গা পাথরই নয় এক নম্বর লাইনের বিপুল সংখ্যক কাঠের স্লিপারও উঠিয়ে সেই স্থানে সিমেন্টের স্লিপার বসানো হয়েছে। পুরনো কাঠের স্লিপারগুলোও এই চক্র লোপাট করে বিক্রি করে দিচ্ছে। এমনকি রেলমিস্ত্রি মোসলেম পরিত্যাক্ত রেল কেটে এর খন্ডাংশ স্থানীয়দের কাছে বিভিন্ন সময় বিক্রি করে আসছেন।

অন্যদিকে, কাওরাইদ রেলস্টেশনের উত্তরপার্শ্বে পুরনো পানির ট্যাংক সংলগ্ন স্থানে রেল কর্মচারীদের কোয়ার্টার ছিল। দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় পরিত্যাক্ত এই কোয়ার্টার ভেঙ্গে রেলমিস্ত্রি স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে রেললাইন সংলগ্ন সড়কের পাশে বেশকয়েকটি দোকান ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। সেখানে বর্তমানে অনেকগুলো সেলুন রয়েছে।

ভেকু দিয়ে মাটি থেকে পাথর আলাদা করা হচ্ছে

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এসব সেলুন ঘরের জন্য প্রতিটির বিপরীতে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি নিয়েছেন মোসলেম। সেলুনের পেছনে কোয়ার্টার ভেঙ্গে নির্মাণ করা বাড়িটিও ভাড়া দেওয়া। জানা গেছে, সড়কের পাশে অন্তত ৬-৭টি দোকান ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। মার্কেটের পেছনে আরও ১০-১৫টি ঘর ভাড়া দেওয়া রয়েছে। স্থানীয় বেলদিয়া গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় আঞ্চলিক প্রভাব খাটিয়ে ও রেলের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের যোগসাজশে রেলমিস্ত্রি মোসলেম উদ্দিন বাবু অবাধে এসব লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে।

লুটপাটের মূলহোতা রেলমিস্ত্রি মোসলেম উদ্দিন বাবু

এবিষয়ে রেলওয়ে মিস্ত্রি মোসলেম উদ্দিন বাবুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বলেন, ‘নতুন লাইন বসানোর সময় এলাকার মানুষ কিছু মাটি-পাথর নিয়ে থাকতে পারে, তবে আমি এবিষয়ে কিছু জানি না।’ রেলওয়ের পরিত্যক্ত কোয়ার্টার ভেঙ্গে মার্কেট গড়ে তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে এই রেল কর্মচারী কোন সদুত্তর না দিয়ে বলেন, ‘মাত্র দু’বছর আর চাকুরি আছে। অনেকে শত্রুতা করে আমার বিরুদ্ধে বলতে পারে। আমার ক্ষতি করবেন না। ’

কাওরাইদ রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার (জুনিয়র) নয়ন মিয়ার কাছে সংস্কারাধীন এক নম্বর লাইনের পাথর কোথায় জানতে চাইলে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। তবে পাশেই থাকা নুরুল ইসলাম নামে এক রেল কর্মচারী বলেন, ‘আমরা জানলেও এবিষয়ে বলতে পারব না। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

পরিত্যাক্ত কোয়ার্টার ভেঙ্গে গড়ে তোলা মার্কেট

বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (প্রকৌশল) আল ফাত্তাহ মোঃ মাসউদুর রহমানের কাছে এতথ্য তুলে ধরে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে চাওয়া হলে তিনি রেলওয়ের সম্পদ ও সম্পত্তি রক্ষায় কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে বলেন, ‘রেলওয়ের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী বিষয়টি তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। জড়িত রেলমিস্ত্রিকে বরখাস্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’