ছবি: বহুমাত্রিক.কম
ঘন গজারি বনের আশেপাশে বসতি গড়ে বহুযুগ পূর্বে অরণ্যচারী যেই মানুষেরা শিমুলতলার শ্যামল জনপদে আলো জ্বালিয়েছিলেন, বংশপরম্পরায় তারা আজও নিজেদের জয়যাত্রা ঘোষণা করেই চলছেন।
সাম্প্রতিক দশকে দেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার শিমুলতলা গ্রামের ঘরে ঘরে কুপি-হারিকেনের বদলে বিদ্যুত-বাতির ঝকঝকে যে আলো জ্বলেছে, তা কেবল অধিবাসীদের ঘরকেই আলোকিত করেনি, বাড়িয়েছে উন্নত জীবনের আকাঙ্খাকেও। লাল মাটির পায়ে হাঁটা সেই মেঠো পথটিও ২০১৮ সালে ইটের সলিং সড়কে উন্নীত করেছে সরকারের ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। জীবিকার চিরায়ত মাধ্যম কৃষির সঙ্গে যোগ হয়েছে মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি-ডেইরি খামার ও বাণিজ্যিক কৃষির মতো প্রচেষ্টা। জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ শ্রম দিচ্ছে তৈরি পোশাক কারখানায়, কেউবা আবার সরকারি-বেসরকারি চাকুরিতে যোগ দিয়ে উন্নত নাগরিক জীবনের স্বাদ নিতেও পিছিয়ে নেই।
তবে অরণ্যচারী আদিম মানুষদের উত্তরাধিকার এখনকার প্রজন্মও তাদের প্রিয় গ্রামকে কত ভালোবাসেন তা প্রকাশ্যে আসে দূর্যোগের সময়গুলোতে। সুতী আর মাটিকাটা অববাহিকার এই জনপদের মানুষেরা দূর্যোগকালে পুরনো বিভেদ ভুলে ঐক্যের এক অভূতপূর্ব শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়। শুধু শিমুলতলার কথাই কেন বলছি, বাংলার প্রতিটি গ্রামেই বোধহয় পরম্পরায় এমন চিরায়ত ঐক্যকে লালন করে চলছে।
সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণে শিমুলতলার পূর্বাংশের জনপদে একমাত্র সড়কটির ‘চিতার আগার’ অংশে সলিং সড়কের মাঝামাঝি বিপজ্জনক ভাবে মাটি ধ্বসে পড়ে। অরণ্যসংকুল এই অঞ্চলে কোন কালে এখানে চিতা বাঘেদের দল আড্ডা জমাতো নাকি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মৃত সৎকারে চিতা জ্বলতো-তা জানবার সুযোগ হয়তো আজ নেই। বিলের বুক চিড়ে চলে যাওয়া সড়কটির উভয় পাশের মাটি সরে গিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে স্থানীয়দের যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন হুমকির মুখে পড়ে।
বহু যুগের অপেক্ষার পর ইটের এই সড়কটি অধিবাসীদের কাছে রীতিমতো তাদের মর্যাদা ও গর্বের এক নামও হয়ে উঠেছিল। সম্প্রতি বাড়ি গিয়ে আমার গ্রাম শিমুলতলার ‘মর্যাদা’র এই প্রতীককে এমন বিপন্নদশায় দেখে ব্যথিত হই। পাড়ার একমাত্র দোকানে সন্ধ্যার পর বসে জমজমাট আড্ডা। বয়স্করা মাঝেমধ্যে শরিক হলেও তরুণরাই এই আড্ডার মধ্যমণি।
ফোনে যখনই ‘আড্ডা’র কয়েক তরুণকে বলি, ‘তোমাদের গৌরব যে বিলের পানিতে মিশছে-তার কী কোনো হুঁশ আছে তোমাদের?’ তারা তাদের কর্তব্য বুঝতে মোটেও দেরি করেনি, এই বলে তারা নিজেদের রক্ষা করলো যে, ‘মুরুব্বিরা কেন বলছে না তাদের!’ যাক, রাতেই স্থির হলো গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাঁশ কেটে আনা হবে। তারপর মাপ মতো কেটে সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত দুই অংশেই পুতে দিয়ে সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হবে।
কথা মতো গেল শুক্রবার সড়ক রক্ষার এই কর্মযজ্ঞ শুরু হলো। জেঠাতো ভাই মৎস্য চাষি শফিকুল ইসলামকে ডেকে নিতে সকালে ফোন করে জানলাম, তিনি ভোরেই আমাদের বাড়ি ঘুরে গেছেন, ঘুমিয়ে আছি বলে ডাকেননি। এমন কর্তব্যের তাগিদ জেনে উৎসাহই পেলাম। মুহূর্তেই একে একে জড়ো হয়ে গেল আরও ৭-৮ জন তরুণ।
ছুটে এলেন জেঠাতো ভাই আবুল হোসেন, চাচাতো ভাই জাহিদ হাসান মুন্না, রাসেল, ভাতিজা রিজভী, ফারুক, ভাগিনা কাওসারসহ আরও কয়েকজন। দা-কুড়াল নিয়ে আমরা বাঁশ সংগ্রহে নেমে পড়লাম। প্রচুর সংখ্যক বাঁশ সংগ্রহের পর সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে পৌছাতে ভ্যানগাড়ির প্রয়োজন পড়লো। রীতিমতো উৎসব আমেজে সড়ক সংস্কারের স্বেচ্ছাশ্রমে আমার গ্রামের তরুণরা যে অভূতপূর্ব উদ্যোম দেখালো তাতে আরও অতীতের কথা মনে পড়ে গেল।
দুই আড়াই দশক পূর্বে যখন বর্ষার মৌসুমে চারপাশ পানিতে থই থই করতো তখনো এই গ্রামের মানুষেরা এভাবেই স্বেচ্ছাশ্রমে রাতারাতি কাঠের পুল তৈরি করে ফেলতেন। মুরুব্বিদের দুই এক হাঁক-ডাকেই সবাই ছুটে গিয়ে লেগে পড়তেন পুল নির্মাণের কাজে। বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে কাঁধে করে নিয়ে আসার সেই দৃশ্য এখনকার সড়কের ভাঙ্গন ঠেকানোর কর্মযজ্ঞেরই যেন পরম্পরা!
দুপুর বারোটায় আমরা বিরতি দিয়ে গোসল সেরে সবাই মসজিদে পবিত্র জুমার নামায আদায় করতে সমবেত হলাম। নামায শেষে মুরুব্বিরা তরুণদের উৎসাহ জানিয়ে সকলকে এই স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নেয়ার ‘হুকুম’ জারি করলেন। দুপুর না গড়াতেই ফের চিতার আগারে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিড় বাড়তেই থাকলো। এবার শুধু তরুণরাই নয়, মুরুব্বিরাও উৎসাহ নিয়ে লেগে গেলেন কাজে! বড় ভাই মাওলানা আবদুল বারেক, শিক্ষক নুরুল ইসলাম, সুরুজ মিয়া, নাজিম উদ্দিন ও আমার বাবা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদির এসে শুধু আমাদের উৎসাহই দিলেন না, নিজেরাও লেগে গেলেন কাজে।
স্থানীয়দের টানা দুই দিনের শ্রমে-ঘামে প্রায় ধ্বসে পড়ার হাত থেকে সড়কটি কিছুটা নিরাপদ হলো। উৎসাহের সঙ্গে বিপুল এই কর্মযজ্ঞ যখন চলছিল তখন আমার মমতাময়ী জননী শরিফুন্নাহার শুকনা খাবার, চা ও পানি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন আমাদের প্রেরণা যোগাতে। গ্রামে ছোট-ছোট শিশুরা ভিড় জমিয়ে নিজেদের সংহতি জানাচ্ছিল। শিশুদের এই আনন্দ-জমায়েতেও যে কর্তব্যের বীজ রোপিত হচ্ছিল তা যেন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম। গ্রামের সংকটে এভাবেই যে তোমাদের এগিয়ে আসতে হবে ঐক্যের শক্তি নিয়ে-আগামীর প্রজন্মের কাছে আমাদের এই প্রচেষ্টা যেন সেই বার্তাই বয়ে নিয়ে যায়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম
বহুমাত্রিক.কম