ছবি-সংগৃহীত
ঢাকা : দুর্যোগ প্রশমন দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে একথা জোর দিয়েই বলা যায়, উপকূলীয় এলাকায় জীবিকা ও সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে।
মেয়েরা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি পুষ্টিহীনতার শিকার। নিরাপদ পানির দুস্প্রাপ্যতার কারণে পানি সংগ্রহের জন্য তাদের মাইলের পরে মাইল পাড়ি দিতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই ঘূর্নিঝড় আক্রান্ত বাংলাদেশ আজ দুর্যোগের দেশ হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এই ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বহুবার আঘাত হেনে সৃষ্টি করছে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এবং বিশেষ করে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে শতাব্দীর ভয়াবহতম ঝড় আঘাত হেনেছে দেশের উপকূলীয় এলাকায়। এ ভয়াবহতম এসব ঝড়ের সৃষ্টির উৎপত্তি মূলতঃ বঙ্গোপসাগরে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী স্থানে অথবা দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী উত্তর অক্ষাংশে বায়ুমন্ডলে সৃষ্ট নিন্ম চাপের ফলে।
বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল, মে, জুন এবং অক্টোবর, নভেম্বর মাসের দিকে এ সকল ঘূর্নিঝড় হয়ে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যখন ২৫ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু গরম ও হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায় এবং পার্শ্ববর্তী বায়ু ওই বায়ুশূন্য স্থানে ব্যাপকভাবে জমা হয়ে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘূর্নিপাকের সৃষ্টি করে। যার আকৃতি চোখ সদৃশ পেঁচানো এবং লেজবিশিষ্ট যা ঘূর্নিপাক খেতে খেতে ফানেল আকৃতি বিশিষ্ট বঙ্গপোসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানে।
এ অঞ্চলের উপকূলীয় রেখা, নিন্ম সমতল ভূমি, জনসংখ্যার বাড়তি ঘনত্ব, পরিকল্পনাহীন ঘরবাড়ি, দুর্বলভাবে তৈরি বাঁধ এবং ফসলের ক্ষেত সামুদ্রিক ঘূর্নিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। সমস্থ প্রকৃতিটা যেন ভাগাড়ে পরিণত হয়। মানুষের সম্পদ নষ্ট হয়ে যায়, জনযোগাযোগ ব্যাহত হয়,চারদিকে ধ্বনিত হয় হাহাকার আর কান্নার শব্দ। নিস্তব্ধ, নিরবতা, কাকুতি মিনতি যেন বেঁচে থাকার এক বাস্তব সংগ্রাম।
দুর্যোগ “ঘূর্নিঝড়” মূলতঃ বাংলাদেশের অবস্থানগত প্রেক্ষাপটে পরিচিত সহচর। এই ভয়াবহতম দুর্যোগকে কখনোই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এটি প্রকৃতির লীলা। তবে একটি সুপরিকল্পিত উদ্যোগই এজন্য যথেষ্ট। আর এজন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষ সমন্বিত উদ্যোগ। ভৌগোলিক এ সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে দুর্যোগের ভয়াবহতাকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের সার্বিক সেবা যদি একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা যায় তবেই দুর্যোগকে জয় করা সম্ভব।
দুর্যোগকালীন সময় আমাদের দেশে মূলতঃ নারীরা (গর্ভবতী মহিলা, শিশু, বালিকা) বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, জনগণের বিশাল এ সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে নারী ও শিশু, পরিবারে বিভিন্ন দিক থেকে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি অংশগ্রহণ করে থাকে,এটা মূলত বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হয়ে আসছে।
সন্তান লালন পালন ও সার্বিক, সার্বক্ষনিক পরিচর্যা ও তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বও থাকে এই নারীদের উপর। গবাদি পশু ও হাঁস, মুরগি পালন,বাড়ির আঙিনায় সবজির আবাদ এমনকি ফসলাদি উৎপাদানের ক্ষেত্রে এবং সার্বিক রক্ষনাবেক্ষন নারীরাই করে থাকে। সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি বাড়িতে মায়েদের দ্বারাই শুরু হয়, সভ্য ও সমাজ উন্নয়নের জন্যে নারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ না থাকলে সেটি হয় একমুখী বা অসম্পূর্ন, যেহেতু দুর্যোগ পূর্ব এবং পরবর্তী পর্যায়ে নারীর ভূমিকা গুরুত্ববহ ও ফলপ্রসু, তা বিবেচনা করেই তাকে সামাজিক অংশগ্রহণে নিশ্চিত করতে হবে।
দুর্যোগের সময় নারীরাই মূলতঃ স্বাভাবিক সাংসারিক কাজের সাথে যুক্ত থাকে যে কারণে নারীরা ক্ষতিগ্রস্থ বেশি হয়। যেমন রান্না-বান্নার কাজে, সন্তান লালন পালন ও তত্ত্বাবধায়ন, খাবার পানি ও জ্বালানি সংগ্রহ, শিশুদের নিরাপদে রাখা, খাদ্যশস্য ও শস্য বীজ শুকনো জায়গায় নিরাপদে রাখা, মূল্যবান জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে রাখা। এছাড়াও মহিলার স্বাস্থ্যগত এবং মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। নারী-পুরুষ সমন্বিত উদ্যোগকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সুন্দর সুপরিকল্পিত সমাজ গঠন করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে নারীর সামাজিক অংশগ্রহণ, সুপরিকল্পিত বাস্তবায়ন, নারী-পুরুষের শ্রমের ধরণ, নারী পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক ও দক্ষতা, সামাজীকিকরণ থাকা বাঞ্চনীয়। জনম্মুখে নারীর অনুপস্থিতি এই নয় যে, নারী অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি থেকে বঞ্চিত। যেহেতু নারীরা খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করেন যা বেঁচে থাকার তাগিদে মূল উপাদান সেক্ষেত্রে তারা পুরুষের দায়িত্বের মতই গুরুত্বপূর্ন ও দৃশ্যমান।
পরিবারের প্রবীণ মহিলারা শস্যবীজ নির্বাচনসহ বীজের অঙ্কুরোদগম করে থাকেন বাড়িতেই। যদিও তারা মাঠে কাজ করেন না তবুও মূল ভূমিকায় তারাই পুরুষদের সহযোগিতা করে আসছে। ভূমি ব্যবস্থাপনার উপর সন্তানদের পরামর্শ নারীদের দ্বারাই হয়ে থাকে। পরিবারের গুরুদায়িত্ব নারীদের ঘিরেই হয়ে থাকে। কেননা সন্তান পরিচর্যা, গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রক্ষনাবেক্ষণ, হস্তশিল্প, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্যচাষ, সবজি বাগান ইত্যাদি কাজে সর্বাধিক সময় ব্যয় করেন। তাই দুর্যোগ প্রশমনে নারীদের অংশগ্রহণ দুর্যোগ বিষয়ক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে।
নারীদের কর্মসংস্থান নারী সমাজকে শ্রম এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করবে এবং ভিক্ষা-বেশ্যাবৃত্তির মত নিন্দিত কাজ থেকে পরিত্রাণ দিবে। এজন্য নারীকে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে দিতে হবে। এতে তারা দীর্ঘমেয়াদী সুফল না পেলেও স্বল্প সময়ের জন্য উপকার পেয়ে থাকবে। বাংলাদেশী সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অধিকারকে পুরুষদ্বারা কুক্ষিগত রাখা হয়েছে। যা একটি নারীকে শিশু অবস্থায় বাবা-মা, বিয়ের পর স্বামীর গৃহে সীমাবদ্ধতা, সামাজিক দ্বায়ভার, সামাজিক রীতিনীতি, কৃষ্টি, ধর্মের বিধিনিষেধ নারীকে পরনির্ভর করে রাখছে, দুর্যোগ প্রশমন বাস্তবায়ন সুপরিকল্পিত সমাজ পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করি।
অবশ্য সবাইকে এই বিষয়টি জানা জরুরি, দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে গরীব মানুষ। আবার এর মধ্যে প্রধানত শিশু, নারী, প্রতিবন্ধী এবং বয়স্করা উল্লেখযোগ্য। দুর্যোগের পরেও সমাজকে পূর্ন রূপদান করতে তাদের উপর চাপ বেশি থাকে, তাই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য যত পরিকল্পনা (স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে) হবে তাতে শিশু, নারী, প্রতিবন্ধী এবং বয়স্কদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক বিশেষ কার্যক্রম থাকা বাঞ্চনীয়।
আব্দুল্লাহ আল সা’দ : শিক্ষার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বহুমাত্রিক.কম