
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে স্বাধীন মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম জেটিও-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও এবং প্রখ্যাত বৃটিশ-আমেরিকান সাংবাদিক মেহেদী হাসানের সঙ্গে প্রায় ৩৫ মিনিটের এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির চেষ্টা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইসরাইল সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার পুনঃস্থাপন, মিয়ানমার ও গাজায় মানবিক বিপর্যয় এবং গণহত্যা, বাংলাদেশে গত বছরের ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের উত্তরাধিকার, কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, নবগঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) নিয়ে তার অবস্থান, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য গ্লোবাল অ্যাকশন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিতকরণ, বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের কথিত নির্যাতন, শেখ হাসিনার বিচার ও বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে দীর্ঘসময় নেয়ার কারণ ইত্যাদি বিষয়ক প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন মিডিয়া প্লাটফর্ম জেটিও এবং এর প্রতিষ্ঠাতা নন্দিত সাংবাদিক মেহেদী হাসান অতিথিকে কঠিন প্রশ্ন করা এবং তীক্ষ্ণ সাক্ষাৎকার শৈলীর জন্য ইতিমধ্যেই বহুল পরিচিত ও প্রশংসিত। ড. ইউনূসের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারটিও এর ব্যতিক্রম নয়।
সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করার তার সরকারের সিদ্ধান্তকে জোর সমর্থন করেন এবং এই পদক্ষেপ গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে অথবা অতীতের দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে বলে যে আন্তর্জাতিক সমালোচনা তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। সাংবাদিক মেহেদী হাসান এ বিষয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ইতিপূর্বে উত্থাপিত উদ্বেগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. ইউনূস এর বিরুদ্ধে পাল্টা বক্তব্য দেন। অমর্ত্য সেন ইতিপূর্বে সতর্ক করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হাসিনার শাসনামলের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।
জবাবে ড. ইউনূস বলেন ‘এটি ভুল সমালোচনা, আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। দলটি বৈধ রয়েছে। যা স্থগিত করা হয়েছে তা হলো এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।’ তার সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে ইউনূস ব্যাখ্যা করেন যে, নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগকে আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য বিঘ্নকারী হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। তারা মনে করছে, আপাতত তাদেরকে (আওয়ামী লীগ) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না দেয়াই ভালো। তবে স্থগিতাদেশ স্থায়ী নয়। যেকোনো সময় তা প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
লাখ লাখ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কণ্ঠস্বর প্রকাশে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে কিনা -মেহেদী হাসানের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস আওয়ামী লীগ দলের ভিত্তির স্কেলকে ছোট করে দেখান। তিনি বলেন, ‘আমি বলব না লাখ লাখ। তাদের সমর্থক আছে, কিন্তু আমি জানি না কতজন বাকি আছে। অনেকেই প্রকৃত সমর্থক ছিলেন না, বরং ক্ষমতার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন।’ ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন যে, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বৈধ ভোটার হিসেবে থাকবেন, যারা আসন্ন নির্বাচনে অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে থেকে তাদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নিতে পারবেন।
ইউনূস আরও অভিযোগ করেন যে, গত বছর ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের জন্য আওয়ামী লীগ দলটির কোনো অনুশোচনা নেই, যেখানে জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে আনুমানিক ১,৪০০ জন নিহত হয়েছিল। তারা হত্যাকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি, বা তাদের কাজের জন্য দায় স্বীকার করেনি। একটি শব্দও নয়। তিনি বলেন, ‘এইসব কারণে দলটির স্থগিতাদেশকে ন্যায্যতা দেয়া হয়েছে।’
হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার খবরের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। গত নভেম্বরে হাজার হাজার হিন্দুর বিক্ষোভ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পসহ বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিত্বদের সমালোচনার জবাবে, ইউনূস এই ধরনের দাবিগুলোকে ‘ভুয়া খবর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি ভারতকে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করেছেন। ‘সম্প্রদায়ের (হিন্দু-মুসলিম) মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে। কখনও কখনও জমি বা পাড়ার দ্বন্দ্ব থাকে। কিন্তু পদ্ধতিগত হিন্দু-বিরোধী সহিংসতার ধারণাটি অতিরঞ্জিত’ বলেন ইউনূস। সমালোচনা সত্ত্বেও ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন যে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশকে জর্জরিত করা কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক চক্রের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে আওয়ামী লীগের সাময়িক স্থগিতাদেশ প্রয়োজনীয়।
ইউনূস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্নগুলো কার্যত এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘এটি হোক নোবেল কমিটির বিষয়। তারা সিদ্ধান্ত নিক’, জবাবে মেহেদি হাসান অট্টহেসে বলেন, ‘‘উত্তরটি খুব ভালো হয়েছে, খুব ভালো ‘কূটনৈতিক উত্তর’।”
বিদেশনীতি বিষয়ক প্রশ্নে ড. ইউনূস এ বছর বাংলাদেশের পাসপোর্টে ‘ইসরাইল ছাড়া সকল দেশের জন্য বৈধ’ লাইন পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ভ্রমণ দলিলে থাকা এই বাক্যাংশটি ২০২১ সালে শেখ হাসিনার সরকার দ্বারা সরানো হয়েছিল। ইউনূস ব্যাখ্যা করেন, পুরো বাংলাদেশই সেই সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিল। আমরা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিইনি এবং আমরা এমন কোনো খোলামেলা পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই না। লাইন পুনঃস্থাপন জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন।
গাজায় চলমান যুদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে ইউনূস সরাসরি বলেন, ‘ভয়াবহ। এটা বলতে নোবেল বিজয়ী হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন মানুষ হিসেবেই এটি বলা যায় যে, এটা গণহত্যা। শিশুরা মারা যাচ্ছে, মানুষ খাদ্যের জন্য দৌড়াচ্ছে, তারা খেতে পারছে না। পুরো বিশ্বের জন্য লজ্জার বিষয় যে, আমরা আমাদের স্ক্রিনে এটি দেখি কিন্তু কিছুই করি না।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’র (এনসিপি) বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করেননি। ২৭ বছর বয়সী সাবেক ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এই দলটি গঠিত হলেও ইউনূস তার সরকার প্রধান হিসেবে নিরপেক্ষ থাকা জরুরি বলে উল্লেখ করেছেন। সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে তিনি বলেন, ‘যদি আমি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কিছু বলি, তাহলে আমি পক্ষপাতপূর্ণ মনে হবে। আমি শুধু আওয়ামী লীগ নিয়ে মন্তব্য করি, কারণ তারা এখন দৃশ্যপটের বাইরে।’
গত বছরের ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়া এবং কিছু সময়ের জন্য ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের অংশ থাকা নাহিদ ইসলামের নতুন দলকে কিছু সমালোচক ইউনূসের প্রোটেজে হিসেবে দেখলেও মেহেদী হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ‘এটি তাদের অনুমান’ ড. ইউনূস বলেন। তিনি বলেন ‘হ্যাঁ, তিনি সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন যারা আমাকে ডেকেছিল। তার সঙ্গে সম্পর্কটা আছে, কিন্তু আমি তাকে সমর্থন করিনি। এটি তাদের দল; তাদেরকে নিজেরা নিজেদের নীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম ব্যাখ্যা করতে হবে।’