Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ২২ ১৪৩২, সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫

রবীন্দ্র মনে মৃত্যুশোক

গৌতম কুমার রায়

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ৩০ মার্চ ২০১৫

আপডেট: ২০:২৭, ৭ এপ্রিল ২০১৫

প্রিন্ট:

রবীন্দ্র মনে মৃত্যুশোক

ঢাকা: জীবনের অবধারিত সত্য ঘটনা মৃত্যু। এই মৃত্যু কখনো শোকে পাথর, কখনো অনুভূতির। তবে কোনো মৃত্যু সুখ দেয় না। যদি কিনা সে মৃত্যু ব্যথাকে আমরা মানবিক সজ্ঞায় ভাবতে শিখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে মৃত্যুশোক এসেছিল শৈশব বয়সে। ওই অল্প বয়সে এই শোক অনুভূতি প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, ‘শিশুদের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়, কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুকে পাতিয়া লইতে হইয়াছিল।’

রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন ধাপে অনেক প্রিয়জনের মৃত্যুর ব্যথা সামনে এসে হাজির হয়েছিল। এক একটি মৃত্যু এক এক ধরনের শোক ব্যথা গেঁথে দিয়েছিল। সেটা হতে পারে বয়সের তারতম্যে অথবা ঘটনার তারতম্যে। শৈশবে কবি হারিয়েছিলেন মমতাময়ী মাকে। তারপর প্রথম যৌবনে বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু। এরপরে প্রিয়তমা পত্নী মৃণালিনী দেবী, মধ্যমা কন্যা রেণুকা, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জেষ্ঠ্যা কন্যা বেলা, দৌহিদ্র নীতীন্দ্রর অকাল মৃত্যু। অবশেষে কবির বার্ধক্য জীবনে এসে মৃত্যুশোক আসে ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাবসানে। বার বার মৃত্যুশোক আলিঙ্গন করেছিল কবিকে। তিনি তাকে সামলেছেন প্রকৃতির সাবলীল ধারণা দিয়েই।

মমতাময়ী মায়ের মৃত্যু অনুভূতিতে কবি বলেছিলেন, ‘‘মার যখন মৃত্যু হয় তখন আমার বয়স অল্প। অনেক দিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনের শেষ সময় উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়। তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে রাত্রিতে তাহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি তাহা জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কি সর্বনাশ হলো রে!” ... ... ... প্রভাতে উঠিয়া যখন মার মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহপ্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ঙ্কর সে দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না।”

শৈশব বয়সের মৃত্যুর দুঃখটার করুণ সুর না থামতেই যৌবনে পদার্পণের সাথে সাথে বৌঠান কাদম্বরী দেবী মারা গেলেন। এবার কবিমনে এক বিরাট বেদনা বাসা করল। কবি তাই স্বমহিমায় ব্যক্ত করলেন, ‘আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ শোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া চলিয়াছে।’

আমরা দেখেছি চব্বিশ বছর হতে কবির জীবনে যে মৃত্যুগুলো আলিঙ্গন করেছে, তা পর্যায়ক্রমে শোক বারতাকে বহন করে নিয়ে গেছে। কোনো বেদনাই কবিকে রুদ্ধ করতে পারেনি।
১৯০২ সাল। ৪১ বছর বয়সে কবি হারালেন পরমা পত্নী মৃণালিনী দেবীকে। কবিপতœী চলে গেলেন। একাকী রবীন্দ্রনাথ নিতান্তই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। পত্নীর অসুখে তার প্রতি কবি স্নেহ পরশের কোনো ঘাটতি আমরা দেখি না। বরঞ্চ মৃণালিনী দেবী যখন অসুখে বিছানাগত তখন কবি সারারাত হাতপাখা পিটিয়ে বাতাস করে প্রিয়তমাকে শান্তির পরশ মাখিয়ে দিতেন। কবির মনে কখনো এতটুকু কান্তি আসতে দেখিনি। তবে কবির পত্নী মারা যাওয়ার ক’দিন পরে রবীন্দ্রনাথ বন্ধুবর দীনেশচন্দ্র সেনকে লিখেছিলেন, ‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়াছেন তাহা যদি নিরর্থক হয় তবে এমন বিড়ম্বনা আর কি হইতে পারে। ইহা আমি মাথা নীচু করিয়া গ্রহণ করিলাম। যিনি আপন জীবনের দ্বারা আমাকে সহায়বান করিয়া রাখিয়াছিলেন তিনি মৃত্যুর দ্বারাও আমার জীবনের অবশিষ্ট কালকে সার্থক করিবেন। তাহার কল্যাণী স্মৃতি আমার সমস্ত কল্যাণ কর্মের নিত্য সহায়ক হইয়া আমাকে বলদান করিবে।’

১৯০৩ সালের মে মাস। গত ক’মাস আগে স্ত্রী বিয়োগ ব্যথা কাটিয়ে না উঠতেই এবারে কবি হারালেন মেঝো মেয়ে রেণুকা বা স্নেহের রাণীকে। মা’হারা মেয়ের পিতৃ আদরের সাথে সাথে মায়ের অভাবকে এতটুকু বুঝতে দিতেন না কবি। নিজ হাতে ওষুধ খাওয়ানো, বাতাস দেয়া, এমন কি মেয়েকে খুশি রাখতে রাত জেগে কবিতা লিখে তা পড়ে পড়ে আবৃত্তি করে মেয়েকে খুশি রাখা হতো। কবির কথায় ‘মৃত্যুর ঠিক আগে মেয়ে বললÑবাবা পিতা নোহসি বলো। আমি মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ল। তার জীবনের চরম মুহূর্তে সে কেন পিতা নোহসি স্মরণ করল তার ঠিক মানেটা আমি বুঝতে পারলাম। তার বাবাই যে তার জীবনের সব ছিল তাই মৃত্যুর হাতে যখন আত্মসমর্পণ করতে হলো তখনই বাবার হাত ধরেই সে দরজাটুকু পার হতে চেয়েছিল। তখনো তার বাবাই একমাত্র ভরসা ও আশ্রয়। বাবা কাছে আছে জানলে আর কোনো ভয় নেই। সেজন্যও ভগবানকেও পিতারূপে কল্পনা করে তার হাত ধরে অজানা পথের ভয় কাটাবার চেষ্টা করেছিল। ... তার শেষ কথা আমি যখন তখন শুনতে পাই বলো- বাবা ‘পিতা নোহসি বলো।’

১৯০৩ সালের মে মাস থেকে ১৯০৭ সালের নভেম্বর মাস। মাঝখানে ব্যবধান মাত্র চার বছর ছয় মাস। কবি তার কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথকে হারালেন। প্রকৃতির নির্মম পরিহাস ১৯০২ সালের অগ্রহায়ণ মাসের ৭ তারিখে গেলেন স্ত্রী এবং পাঁচ বছর পরে ১৯০৭ সালের বাংলা ৭ অগ্রহায়ণ একই দিনে ধরাধাম হতে চলে গেলেন শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যথায় অঙ্গার হয়ে কবি এই দুঃখে এতটুকু বিচলিত হননি। বরঞ্চ কবি এই ব্যথার জন্য তার বন্ধু শ্রীশচন্দ্রকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছিল। তবে কবি এই মৃত্যুর অনেক পরে হলেও শমীর মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে চোখের জলে ভিজেছিলেন। কবির কথায়Ñ‘ওর মা যখন মারা যায় তখন ও খুব ছোট। তখন থেকে ওকে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছিলাম। ওর স্বভাব ছিল ঠিক আমার মতো। আমার মতোই গান করতে পারত আর কবিতা ভালোবাসত। ওর জন্য অনেক কবিতা লিখেছি। শমী বলত ‘বাবা গল্প বলো।’

১৯১৮ সাল। শমীর মৃত্যুর এগার বছর পরে কবির জ্যেষ্ঠা মেয়ে মাধুরীলতা (বেলা) চলে গেলেন স্বর্গধামে। দিদি বেলা দেবীর মৃত্যুতে তার সম্পর্কে ভাই রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “দিদি আমাদের সকলের বড় ছিলেন। আর সব ছেলে-মেয়েদের চেয়ে বাবা (রবীন্দ্রনাথ) দিদিকে বেশি ভালোবাসতেন আমরা সেটা খুব জানতুম। কিন্তু তার জন্য কোনোদিনই ঈর্ষাবোধ করিনি। কেননা আমরাও সকলে দিদিকে অত্যন্ত ভালোবাসতুম ও মানতুম। আমাদের যখন পড়াশোনা আরম্ভ হলো দিদি আমাদের ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে যেতে লাগলেন। বাবা তাকে পৃথক করে পড়াতে শুরু করলেন। তখন থেকেই বুঝেছিলেন দিদির লেখবার বেশ ক্ষমতা আছে। বাবা তাকে উৎসাহ দেওয়াতে তিনি কয়েকটা গল্প লিখেছিলেন। দিদিকে সকলে ভালোবাসত আরও একটি কারণে, তার স্বভাব ছিল অত্যন্ত স্নেহশীল।”

কবি এর পরে যার মৃত্যুতে শোকবহ ঘটনার সাক্ষী তিনি কবি দৌহিদ্র নীতীন্দ্রের অকাল প্রয়াণ। এছাড়াও কবির বয়ঃসন্ধিক্ষণে এসে যার জীবনাবসান মনের চঞ্চলতাকে বেশি করে নাড়া দিয়েছে তিনি কবির সন্তান প্রতীম ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বর্গাগমন।

১৮৬১ সাল থেকে ১৯৪১ সালের এই সময়ের বর্ণাঢ্য জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিত বাংলা সাহিত্যের মহিমা যেমন চোখে পড়ার মতো, আবার বারংবার এই জীবনে মৃত্যুর শোকগাঁথা কখনোই আনন্দধারার কাছে প্রশান্তির ছোঁয়া স্পর্শ করতে দেয়নি। কবি প্রিয়জনের মৃত্যুর শোকছায়ায় জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও একজন প্রহরী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। একে একে মৃত্যুর মিছিলে একমাত্র ব্যথা সহ্য করার শ্মশানযাত্রী বাংলা সাহিত্যের মুকুটজয়ী রাজা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি স্বমহিমায় বিশ্বশ্রেষ্ঠ হলেও মৃত্যুর শোক ব্যথায় নিতান্তই একাকী।

লেখক: গবেষক

বহুমাত্রিক.কম