ছবি- সংগৃহীত
( পর্ব – ৪ )
দিন দুই পরে সূর্যশেখর কোর্ট থেকে ফিরে মায়ের ঘরে গেলেন চা খেতে। স্বর্ণ চা নিয়ে এলে ইশারায় ওকেও থাকতে বললেন। স্বর্ণের ইচ্ছে ছিল না। কী কথা কোনদিকে যায় এই ভয়ে। এমনিতে দুইদিন আগেই অশান্তি হয়ে গেছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে এবারে শাশুড়ি তাঁর স্বভাবসুলভ কোনো আচরণ করেননি। অল্প শোকে কাতর ,অধিক শোকে পাথর অবস্থা হয়েছিল মনে হয়।
মা ছেলেকে দেখে ভাবলেন ছেলে হয়তো বা তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই কথা বলতে এসেছে। গত দুইদিন বিশেষ কোনো কথা হয়নি ছেলের সাথে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সূর্য মাকে বললেন
“মা তুমি ভালোই করেছ হিমের বিয়ের কথা বলে। আমি তো ভাবলাম ছেলে এখনো ছোটোই আছে। তাই এদিকটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ওর মাও কিছু বলেননি ( এইটুকু অবশ্য মিথ্যে ছিল। প্রয়োজনে মিথ্যে বললে ক্ষতি কিছু নেই )।
অমনি হেমাঙ্গিনী দেবী স্বমূর্তিতে ফিরে এলেন।
“ওর মায়ের বুদ্ধিশুদ্ধি আর কখন হবে ? ছয়টা সন্তান জন্মই দিতে পেরেছে। এর বাইরে আর কী করতে পেরেছে ? আমি জানতাম তুই আমার কথা ফেলতে পারবিনে”।
ছয়টি সন্তান জন্ম দেয়ার কথা শুনে সূর্যের অপমানে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। আড়চোখে দেখল স্বর্ণ মাথা নিচু করে রেখেছে। বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করে সূর্যশেখর বললেন
“আজ কোর্টে আমাদের এক সিনিয়র উকিল তাঁর ভাইঝির কথা বললেন। বিএ পাশ করেছে। উপযুক্ত পাত্র খুঁজছেন। আমাদের হিমের কথা কারও কাছ থেকে শুনেছেন। অনেকক্ষণ আলাপ হয়েছে। আমার সব মিলিয়ে ভালো লেগেছে। বলেছি ছেলে এবং ওর মায়ের যদি পছন্দ হয় আমার আপত্তি নেই”।
“মানে ? ছেলে কী পছন্দ করবে ? আর ঐ আবাগীর,বলতেই আগের দিনের কথা মনে করে শুধরে নিয়ে বললেন,ওর মা কথা বলতে জানে ? তুই ঊর্মি আর অপরাজিতাকে খবর দে। আমি সহ মেয়ে দেখতে যাবো”।
“না মা। ওটা আমি পারব না। ভদ্রঘরের শিক্ষিতা মেয়ে। সবাই মিলে দল বেঁধে মেয়ে দেখতে যাওয়া আমার পছন্দ নয়। এই রীতিগুলো বাদ দেয়া দরকার। আর তোমার বয়েস হয়েছে। তুমি জমিদার কিরণশেখর রায়চৌধুরীর স্ত্রী। তুমি অন্যের বাড়ি যাবে কনে দেখতে? ছিঃ ছিঃ! কী বলছ”?
“ওঃ ! তার মানে তুই কথা দিয়ে এসেছিস ? নতুন নিয়ম চালু করতে চলেছিস বাড়িতে ? বেশ লায়েক হয়ে উঠেছিস দেখছি”।
“তুমি এভাবে কেন দেখছ ? সময়ের সাথে সাথে মানুষের ধ্যান ধারণায় পরিবর্তন হওয়া উচিত। যে বিয়ে করবে তারই তো মেয়েকে আগে দেখা উচিত। সাথে ছেলের মা যাবে”।
“বৌ এর মন্ত্রণায় চলতে শুরু করেছিস ? ভালো। তা এই সম্পত্তির মালিক যে আমি সেটা তোর জানা আছে”?
সুর্যশেখর মনে মনে হাসলেন। মুখে বললেন
“না মা জানি না। জানতে চাইও না বাবা ঠাকুরদারা কী পরিমাণ সম্পত্তি রেখে গেছেন ? তবে স্বর্ণের নামে আমি বেশকিছু জমি কিনে রেখেছি। আমার অবর্তমানে ওর যেন কোনো কষ্টে পড়তে না হয়”।
হেমাঙ্গিনীর চোয়াল ঝুলে পড়ল। তলে তলে এই !
সেদিকে তাকিয়ে সূর্যশেখর বিষাদের সুরে বললেন
“মা আর একটি কথা। তুমি কথায় কথায় স্বর্ণকে বেশি সন্তান নেয়ার জন্য কথা শোনাও। তোমার মনে থাকে না ঐ সন্তানরা আমারও। আমার এসব কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগে না”। কথা শেষ করে সূর্যশেখর ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আরও একবার মাকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন স্বর্ণের ব্যাপারে তাঁর মনোভাব যে অসুন্দর। মনটা খারাপই ছিল। জানেন এর মাশুল রাতে দিতে হবে। কিন্তু কাঁহাতক মেনে নেওয়া যায় ?
আজ তিনি এই কথাটি তুলতেন না। কিন্তু স্ত্রীর অস্থিরতা বুঝতে পেরে ভাবলেন বিষয়টা ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। সেদিন বললেও মা যেমন জেদি ঠিকই মাসিকে কথা দিয়ে দেবেন। ভাগ্যও তাঁর পক্ষে গেল। বিনয়বাবু তাঁর ভাইঝির কথা বলাতে আলাপ করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন এই মেয়ের কথাই হিমু তার মাকে বলেছিল। তাই সূর্যশেখর নিশ্চিন্তমনে কথা দিয়ে এলেন এবং মাকেও জানিয়ে দিলেন।
স্বর্ণের খুব খারাপ লাগছিল আগে থেকেই যে ছেলে কোনোদিন মায়ের মুখের ওপর একটি কথা বলেনি, সে আজ তাঁর কারণে মাকে মিথ্যে অজুহাত দেবে। এই বোধটি তাঁকে খুব কষ্ট দিত। এক রাতে তো স্বামীকে বলেই ফেললেন
“দরকার নেই মাকে মিথ্যে বলা। আমি হিমুকে বুঝিয়ে বলব”।
“তুমি ওকে কথা দিয়েছ। নিজেকে ছোটো করবে ? এমনিতেই তো সারাজীবন মায়ের কথা মুখ বুজে সহ্য করে ওদের চোখে নিজেকে ঠিক মর্যাদায় রাখতে পারোনি। সেটির জন্য অবশ্য সমানভাবে আমিও দায়ী”।
“আবার শুরু করলে”?
সূর্যশেখর মনে মনে বললেন আমার এই কষ্ট তুমি বুঝবে নাা স্বর্ণলতা। নিজের সন্তানদের সামনেও আমি ছোটো হয়ে থাকি। আমি চাই না হিমু আমার মতো কষ্ট নিয়ে ঘুরুক। আমাদের রাতগুলো আজও কত আনন্দে কাটে। কত গল্প করি আমরা। আমার হিমাদ্রি যে তাও পাবে না।
“কী ভাবছ গো”?
“কিছু না”।
“আমার চোখকে তো তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না জানোই। অনর্থক মিথ্যে বলছ কেন”?
“ভাবছিলাম সারাজীবন তুমি কষ্ট করেছ। এখন ছেলেটাও কষ্ট করবে? আমরা তো রাতটুকু পেতাম একে অপরকে বুঝতে। হিমু যে তাও পাবে না”।
“ওটাই ভাবছি। আমি যে হিমুর আলোজ্বলা মুখ দেখেছি মেয়েটির কথা বলার সময়। কীভাবে ছেলেটাকে বলি সরে আসতে”?
“কিছু বলতে হবে না। আমার বৌটা সারাজীবনে এই একটামাত্র আবদার করেছে। ওটা রাখতেই হবে। তুমি ভেবো না”।
সূর্যশেখর মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরেও হেমাঙ্গিনী অপলক ঐদিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। অপমানে ,রাগে ক্ষোভে তাঁর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণলতা ভয়ে নীল হয়ে গিয়েছিল। মানুষটা এত বৎসর সয়ে যেতে পারল। আজ এভাবে কথা বলতে গেল কেন ? কেন যে অশান্তি ডেকে আনে ! এখন কীভাবে ও সামাল দেবে? স্বর্ণলতা শাশুড়ির পায়ে পড়ল।
“ওমা বিশ্বাস করুন আমি ওকে কিছু বলিনি। মা আমি ওকে এখনি বলছি আপনার কাছে এসে ক্ষমা চাইতে। মা ওকে ক্ষমা করে দিন”।
হেমাঙ্গিনী একবার পুত্রবধূর মুখের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। সূর্যশেখর তখনো মায়ের ঘর থেকে বেশি দূর যায়নি। স্ত্রীর কাকুতি কানে গেল। আবার এসে মায়ের ঘরে ঢুকে দেখতে পেলো স্বর্ণলতা মায়ের পায়ে পড়ে কাঁদছে এবং মায়ের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই দেখে অভিমানে ওঁর মন ভরে গেল।
শক্ত হাতে স্ত্রীকে মায়ের পা থেকে তুলে নিয়ে বললেন
“তুমি কেন পায়ে পড়ছ ? কথা বলেছি আমি। ক্ষমা চাইতে হলে আমি চাইব। তোমার আত্মমর্যাদাবোধ আর কবে হবে”?
“আমার আত্মমর্যাদাবোধ লাগবে না। তুমি মায়ের কাছে ক্ষমা চাও। তুমি ওনার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না”।
“থাক আর নাটক করতে হবে না। তোমরা এখান থেকে যাও”। হেমাঙ্গিনী সতেজে বলে উঠলেন।
“হলো তো”? প্রায় গর্জন করার মতো বললেন সূর্যশেখর।
“তুমি মায়ের কাছে ক্ষমা চাও”।
“সে আমি বুঝব। তুমি ঘরে চলো”।
নিজের সন্তানেরা এবং বাড়িতে থাকা অন্যরা অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেলো ক্রন্দনরতা স্ত্রীর হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন সূর্যশেখর নিজের ঘরের দিকে। যাকে এতদিন সবাই জানত মা অন্তঃপ্রাণ পুত্র। যে কারণে তাঁর মা শান্তশিষ্ট নরম প্রকৃতির বৌটাকে সবসময় বকাঝকার ওপর রাখত। ছেলে কোনোদিন রাটি করেননি। আজ এমন কী হলো যে বৌ হাপুস নয়নে কাঁদছে আর সূর্যশেখর বৌকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন! এমন দৃশ্য কেবল স্বপ্নে দেখা যেতে পারে এই বাড়িতে। আর সেদিন সবাই এটি প্রত্যক্ষ করল আর একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে যে যার ঘরে চলে গেল। কারণটা শুধু বুঝল হিমাদ্রি। অনেকটা সময় স্থানুর মতো নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে মা বাবার ঘরের দিকে গেল। ( চলবে ...)