ছবি: বহুমাত্রিক.কম
ময়মনসিংহ : চিকুনগুনিয়ার ফলপ্রদ নিয়ন্ত্রণে মশা ও মানুষের পাশাপাশি অন্য উৎসগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে, সংক্রমনের সম্ভাব্য উপায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং ভাইরাসের জিনগত বৈচিত্র নিরূপন করতে হবে। এছাড়া স্বাশ্রয়ী মূল্যে ভাইরাস সনাক্তকরনের পদ্ধতি বের করতে হবে যাতে মহামারীর সময় দ্রুত চিকুনগুনিয়া রোগ নির্নয় করা যায়। এজন্য কার্যকর গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।
এ রোগে আতঙ্কিত না হয়ে জন সচেতনতার পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকরা। রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন গ্যালারিতে বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া : সমস্যা ও নিয়ন্ত্রণের উপায় শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে নিয়মিত ময়লা অবজর্না পরিষ্কার, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মশার প্রজনন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাষ ও জলাবায়ুর পরিবর্তন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কীটত্ত্ববিদ পরিবেশবিদ, মেডিকেল ও ভেটেরিনারি পেশার এবং সংশিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ও গবেষক নিয়ে গঠিত কমিটির মতামত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, সিটি কর্পোরেশনের সংশিষ্ট বিভাগ, গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাক্তিবর্গের অংশগ্রহন ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে বক্তারা বলেন, এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে তাই বালতি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার, বাড়ির আশেপাশে প্রভৃতি স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুষ্ক ও আর্দ্র উভয় মৌসুমে এডিস মশা সক্রিয় থাকে, তবে বর্ষার সময় এদের আধিক্য দেখা যায়। তাই বর্ষার আগে জনসচেতনতা শুরু করা, প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে মশা নিধনে পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন। মশার ঋতুর শুরুতে মশার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আবাসস্থল নষ্ট করে দেওয়া ও মশার লার্ভা (বাচ্চা) কে কীটনাশক বা অন্য উপায়ে ধ্বংস করে দিতে হবে। মশার ঋতুতে দেশজুড়ে মশার বিস্তারের একটি মানচিত্র তৈরি করতে হবে। কোন এলাকায় কোন জাতের মশা পাওয়া যায় তার একটি পরিষ্কার চিত্র থাকা প্রয়োজন। মশা ও অন্য কীট নিয়ন্ত্রনে প্রতিটি জেলায় স্থানীয় ইউনিট তৈরি করে সমন্বয়ের মাধ্যমে সারাবছর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
এছাড়া চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কীটত্ত্ববিদ (এন্টোমোলজিস্ট), পরিবেশবিদ, মেডিকেল ও ভেটেরিনারি পেশার এবং সংশিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ও গবেষক নিয়ে গঠিত কমিটির মতামত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, সিটি কর্পোরেশনের সংশিষ্ট বিভাগ, গ্রহনযোগ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাক্তিবর্গের অংশগ্রহন প্রয়োজন বলেও সেমিনারে জানানো হয়।
সম্প্রতিতে দেশে বিশেষ করে ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক প্রকোপ দেখা দেয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও এর প্রাদূর্ভাবের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশের এই সংকটময় মূহুর্তে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবর। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভেটেরিনারি অনুষদের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সহিদুজ্জামান ও কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন হাওলাদার।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী, অধ্যাপক ড. প্রিয় মোহন দাস, অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন, অধ্যাপক ড. মনোরঞ্জন দাস, অধ্যাপক ড. মকবুল হোসেন, অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম, অধ্যাপক ড. আবু হাদী নুর আলী খান, অধ্যাপক ড. কাজী শাহানারা আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ফয়েজ আহমেদ, প্রতিষেধক শাখার প্রধান ডা. মো. শাহাদৎ হোসেনসহ চিকুনগুনিয়া নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ও শাখার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের চিকিৎসকগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ভেটেরিনারি অনুষদের অধ্যাপক ড. নাজিম আহমাদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবর বলেন, চিকনুগুনিয়া বর্তমানে একটি জাতীয় সমস্যা। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ঠ আন্তরিকতার সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। তিনি সকলকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং নিয়ন্ত্রণে সকলকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, এডিস মশা দ্বারা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর শুরু হয় এবং এর সাথে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা থাকে যা কয়েক সপ্তাহ, মাস বা বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই রোগে মৃত্যু ঝুঁকি প্রতি দশ হাজারে এক জন বা এর চেয়েও কম তবে বয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগের জটিলতা তুলনামূলক বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চিকুনগুনিয়া মানুষ ছাড়াও বানর, বাঁদুর, ইঁদুর ও পাখিতে হতে পারে এবং এসব প্রাণি থেকে মানুষে এ রোগের সংক্রমন হতে পারে। এছাড়া মানুষ থেকে মানুষেও এ রোগের সংক্রমন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ১৯৫২ সালে প্রথম তানজানিয়ায় রোগটি সনাক্ত হয়। তবে এখন বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে রোগটি দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রথম উত্তর রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জ ২০০৮ সালে সনাক্ত হয়। ২০১১ সালে পুনরায় এই রোগের আবির্ভাব হয়।
বহুমাত্রিক.কম