
-লাউয়াছড়ায় সন্ধান পাওয়া বিরল লাল চোখ ব্যাঙ। ছবি: প্রতিবেদক
মিশ্র চিরহরিৎ সবুজ বন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। অত্যধিক পর্যটকের আগমনে এখানকার বাস্তুতন্ত্র্যের যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল করোনাকালীন সময়ে সেটি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। গত এক বছর থেকে পর্যটক বন্ধ থাকায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে বনের স্বাভাবিকতা।
বিশ্বে প্রথম আবিস্কৃত লাল চোখ ব্যাঙ নামে নতুন একটি ব্যাঙের পরিচয় পাওয়া গেছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে এর সন্ধান মিলেছে। ফলে লাউয়াছড়ায় নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে লাল চোখ ব্যাঙ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ও প্রাণি গবেষক মুনতাসির আকাশ শুক্রবার বলেন, বিশ্বের মধ্যে প্রথম আবিস্কৃত লাল চোখ ব্যাঙ লাউয়াছড়ায়ই উদ্ভব হয়েছে। এজন্য বনের নিরাপদ পরিবেশ রক্ষা প্রয়োজন। এটি করোনা ভাইরাস থেকে আমাদের শিক্ষনীয়।
লাউয়াছড়ায় গবেষণা করতে বন্যপ্রাণী গবেষক হাসান আল-রাজী ও মার্জান মারিয়া এই ব্যাঙের সন্ধান পান। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিক পয়ারকভ তাদের গবেষণার কাজটি রাশিয়া থেকে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান এবং সার্বিক সহযোগিতা করেন। গত ২৮ মে এই ব্যাঙ নিয়ে তাদের গবেষণাপত্রটি যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব নেচার হিষ্ট্রি’ তে প্রকাশ হয়। গবেষকদের দেয়া এই ব্যাঙের নাম ‘সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙ’। ব্যাঙটির চোখে লাল অংশ থাকায় মূলত এটিকে লাল চোখ ব্যাঙ বলা হচ্ছে। এর ইংরেজি নাম Sylheti Litter Frog
করোনাকালীন পর্যটকদের আগমন বন্ধ থাকায় লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে জীববৈচিত্র্যে স্বস্তি ফিরেছে। সংশ্লিষ্টরাও এর সত্যতা পেয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আজিজ লাউয়াছড়ায় এসে এমন বাস্তবতা উপলব্ধি করে বলেন, ‘করোনা থেকে বড় শিক্ষা হচ্ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মায়া হরিণের ডাক। সকালে রাস্তা দিয়ে আসার সময় মায়া হরিণের ডাক শোনা যায়। পূর্বে সচরাচর এমন ডাক শুনা যেত না। করোনা থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা এটি। পর্যটক না থাকার কারণে বনের স্বাভাবিক পরিবেশে বন্যপ্রাণিদের এমন স্বস্তি দেখা দিয়েছে।’
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে দাঁড়িয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বাস্তুতন্ত্রের এই আশাব্যঞ্জক খবর প্রকৃতিতে কিছু বার্তাও নিয়ে এসেছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পর্যটকদের জন্য বন্ধ রয়েছে উদ্যানটি। ফলে মানুষের উৎপাত নেই। এক বছরের ব্যবধানেই বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। পর্যটক শুন্য নিরব, নি:স্তব্দ বনে হাল্লা-চিৎকার ও অবাদ বিচরণ করছে বন্যপ্রাণী। গাছের ডালে ডালে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। বৃক্ষরাজিতে নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হচ্ছে বন। দিবালোকে বন্যপ্রাণী অবাদে বিচরণ করছে। গর্ভবতী ও প্রসবের পর বাচ্চাদের নিয়ে বিরল প্রজাতির উল্লুক দম্পত্তির দেখা মিলছে। এখন উল্লুকের আওয়াজ, বানরের লাফালাফি, পাখির কলরব, বনমোরগের ডাক শুনারও সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। সাময়িক সময় হলেও বনের স্বাভাবিকতা ও বন্যপ্রাণি প্রাণচাঞ্চল্য প্রকৃতি ও পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে তুলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন ঘুরে লাউয়াছড়া বনের বিরল প্রজাতির হুল্লুকসহ গর্ভবর্তী বিভিন্ন প্রাণি ও বাচ্চাদের নিয়ে গাছে গাছে লাফালাফি, খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর চিত্র দেখা যায়। উদ্যানে এখন দলবদ্ধ মানুষের তৎপরতা নেই। নেই পর্যটকদের হাল্লা চিৎকার। করোনাকালীন সময়ে বনের ভেতরে সড়ক ও রেলপথে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল না থাকায় গাড়ির শব্দও বন্ধ ছিল। এতে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে বন্যপ্রাণিরা। বন্যপ্রাণির অবাধ বিচরণ ও বিভিন্ন উদ্ভিদের পুর্নজন্ম হচ্ছে বনটিতে। এরই মধ্যে অনুকুল পরিবেশে গর্ভবতী হচ্ছে এবং বাচ্চা প্রসব করেছে উল্লুক দম্পত্তি। গাছের ডালে ডালে মা ও শিশু উল্লুক খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখা মিলছে বাবা উল্লুককেও। কোন কোনটি গর্ভবতী আবার কোন কোন মা উল্লুক বাচ্চা প্রসব করে মনের আনন্দে বিচরন করছে। দীর্ঘ সময় ধরেই বিরল প্রজাতির এই প্রাণির জন্যে লাউয়াছড়া বনটি গুরুত্ব বহন করে চলছে।
করোনাকালে বন্যপ্রাণিদের এমন অবাধ বিচরণ এখন লাউয়াছড়ায় প্রায়শঃই দেখা যাচ্ছে
স্থানীয়রা জানান, বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকসহ বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণি, উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া উদ্যান। গত কয়েক দশকে এই বনের গভীরতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। প্রাচীন গাছগাছালি চুরি, মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ বিস্ফোরণ, বনের ভেতর দিয়ে উচ্চ শব্দে রেল ও সড়কপথে ট্রেন, যানবাহনের যাতায়াত, গাড়ির হর্ন, অত্যধিক দর্শনার্থীর হইহুল্লোড়, পার্শ্ববর্তী টিলাভূমিতে হোটেল, কটেজ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সব মিলিয়ে অস্থিত্ব সংকটে পড়েছে বন ও বন্যপ্রাণি। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা ও যানবাহন বন্ধ হওয়ায় বনে পর্যটকের কোন উপস্থিতি নেই। এটিই এখন স্বস্তি।
লাউয়াছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা সাজু মারচিয়াংরা জানান, এই বনে প্রতিনিয়ত পর্যটকদের ভিড় থাকতো। উদ্যান বন্ধ ঘোষণায় বনে দিনের বেলা উল্লুকের আওয়াজ, বানরের লাফালাফি, পাখির কিচিরমিচির শব্দ, সন্ধ্যায় বন মোরগের ডাক শুনা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সরকার আরও কয়েক মাসের জন্য উদ্যান বন্ধ ঘোষণা করলে বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতির জন্য খুবই অনুকূল পরিবেশ হতো।
তবে অপরিকল্পিত পর্যটকের আগমন লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে লাউয়াছড়া স্টুডেন্টস ডরমিটরিতে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দু’টি উদ্যানেই অপরিকল্পিত পর্যটক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। তাছাড়া লাউয়াছড়ায় সড়কপথে যানবাহনে কাটা পড়ে বন্যপ্রাণি ও প্রচুর পরিমাণে নানা প্রজাতির সরীসৃপ মারা যাচ্ছে।
বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজারস্থ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এখন বন্যপ্রাণির ডাক ও মা ও শিশু উল্লুক দম্পত্তির অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে মানুষের চলাচলের কারণে বন্যপ্রাণির খাবার সংগ্রহ ও অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা দেখা যেতো। বর্তমানে করোনাকালীন সময়ে বন্যপ্রাণি অবাধে চলাচল করছে এবং উল্লুকসহ অন্যান্য প্রাণিও গর্ভবতী হচ্ছে এবং বাচ্চাও প্রসব করছে। তিনি আরও বলেন, পর্যটক শুন্য থাকায় লাউয়াছড়া ও সাতছড়িতে সমৃদ্ধ হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
বহুমাত্রিক.কম