ছবি: লেখক
ঢাকা : বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে হাওর অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মোহনগঞ্জ একটি প্রথম শ্রেণির পৌর শহর। বাংলাদেশ রেলওয়ের শেষ প্রান্ত। নেত্রকোনা জেলার সীমান্ত সর্বোপরি সুনামগঞ্জ ও বৃহত্তর সিলেট জেলার সাথে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও ঢাকার যোগাযোগের অন্যতম যোগসূত্র রচনা করেছে এই মোহনগঞ্জ।
দেশের পূর্ব-উত্তরাংশের কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫৭টি উপজেলা নিয়ে ভাটির বাংলার হাওর এলাকা গঠিত। হাওরগুলোকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল জলাভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। ভাটিবাংলা হচ্ছে এমনই সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যেখানে ৩৭৩টি হাওরে রয়েছে ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি যা থেকে বছরে একটি ফসল আবাদ করে উৎপাদন হয়- ৫.২৩ মিলিয়ন টন ধান।
মোহনগঞ্জ শহরটি হাওরবেষ্টিত একটি শহর। হাওরের খুব নিকটে না হলেও হাওরাঞ্চলের সাথে শিক্ষা, চিকিৎসা, দাপ্তরিক এবং সাংস্কৃতিক নানামাত্রিক যোগসূত্র রচনায় মোহনগঞ্জ পৌর শহরের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব ও ভুমিকা রয়েছে। জনশ্রুতি আছে তৎকালীন সময়ে হাওরের রাজধানি বলা হতো মোহনগঞ্জকে।
বাঙালির হাজার বছরের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি তার এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর পাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প,আনন্দ-বেদনা ও জীবনযাপনের বর্ণিল উৎসব আয়োজন। বাউল গান, সারিগান, দেহতত্ত্ব, শরিয়তি, মারফতি, মুর্শিদি, মরমী, লোকগীতি, ভাটিয়ালী, পালাগান, ঘেটু গান সহ বিভিন্ন ধর্মী গানের বিশাল সম্ভার এই হাওরাঞ্চলে।
এখানকার মানুষদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আরেক উদাহরণ জোৎস্না উৎসব
হাওরের উর্বর মাটির বুকে জন্ম নিয়েছেন মরমি গায়ক হাছন রাজা, দার্শনিক দেওয়ান আজবফ, বাউল সম্রাট আব্দুল করিম, রাধারমন, দুর্বিন শাহ, শেখ ভানু, পন্ডিত রাম কানাই দাশ, সাহিত্যিক শাহেদ আলী, উকিল মুন্সির মতো যুগস্রষ্টা শিল্পী, মনসুর বয়াতি, সীতালং শাহ, রশিদ উদ্দীন, জালাল খাঁ, শাহ করীমসহ সাহিত্যিক, মনিষীগণ। গবেষণা, চর্চা, সংরক্ষণ এবং পৃষ্টপোষকতার অভাবে এসব কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে।
হাওরাঞ্চলে মান্দি, হাজং, বানাই, কোচ, বর্মণ, খাসি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, লেঙ্গাম, চাবাগানী, ত্রিপুরী, মৈতৈ মণিপুরীসহ রয়েছে আদিবাসী জনগণের এক বিশাল অংশ। হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপন, পানির সাথে সংগ্রাম করে বছরের ৬-৭ মাস টিকে থাকা, হাওরের আফাল (ঢেউ) এর সাথে হাওরবাসীর মানিয়ে নেয়া জীবন শৈল্পিকতা, হাওরের সংস্কৃতি, গান, বিচিত্র পেশা, হাওরের মৎস্য সম্পদ, হাওরের সোনার ফসল, হাওরের সম্ভাবনা, হাওরাঞ্চলের জলেভাসা দ্বীপ ছোট ছোট গ্রাম, ঢেউয়ের গর্জন, হিজল-করচের বাগ, হাওরে চাঁদনি উদযাপন প্রভৃতি আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার কৃষ্টি-সভ্যতার অংশ।
এগুলোর সংরক্ষণ ও বিকাশে মোহনগঞ্জ শহরে বা আশেপাশে একটি হাওর উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক গবেষণাগার স্থাপন করা সময়ের দাবি। হাওর উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র/হাওর সাংস্কৃতিক একাডেমি/ হাওর সাংস্কৃতিক বিকাশ সেন্টার যে নামেই হোক এলাকাবাসির দাবি এমন একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনে জরুরিভিত্তিকে উদ্যোগ নেয়া হোক। হাওর সাংস্কৃতিক একাডেমি স্থাাপিত হলে হাওরাঞ্চলের কৃষ্টি, সভ্যতা, জীবনচর্চা সর্বোপরি আদি বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির সংরক্ষণ, চর্চা ও বিকাশ ঘটবে। যা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বিশ্বের মাঝে নতুনভাবে উপস্থাপনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
হাওর অঞ্চলের জনজীবনের স্বরূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা ছবিতে
এই একাডেমি হলে- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গান ও গায়ক, সংস্কৃতিসেবী, শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের মিলন ঘটানো সম্ভব হবে। হাওরের জীবনমান, কৃষ্টি নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান ও গবেষণা হবে। হাওরের উন্নয়ন কার্যক্রম ও সম্ভাবনা বিষয়ে বিভিন্ন কর্মযজ্ঞের মূল্যায়ন করা হবে। সংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধি পেলে শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবিদের মুল্যায়ন ও মর্যাদা বাড়বে। হাওরের সম্পদ ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর জ্ঞানগর্ভ গবেষণা, লেখালেখি ও প্রকাশনা হবে।
এসব বহুমাত্রিক কর্মযজ্ঞ অনলাইনের বদৌলতে সারাবিশ্বের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করবে। বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল জুড়ে এই হাওর অঞ্চলের জন্য এই গবেষণাগারটি হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন ও সংস্কৃতির বিকাশে অনবদ্য ভুমিকা রাখবে এমনটিই প্রত্যাশা এলাকাবাসির। হাওরের বরপুত্র বলে খ্যাত আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতিও হাওরের জোৎস্না জলের মানুষ।
আমরা দাবি করতেই পারি- আমাদের বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ সর্বোপরি হাওরের উন্নয়নে আগ্রহী আমাদের প্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সদাশয় দৃষ্টিতে বিষয়টি বিবেচিত হবে এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
এস এম মুকুল : বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
বহুমাত্রিক.কম