ছবি : ভারতীয় হাই কমিশন, ঢাকা
ঢাকা : স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারত-বাংলাদেশের আত্মত্যাগ ও গৌরবের সাক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাংক পিটি-৭৬ ও হেলিকপ্টার এমআই ৪ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যুদ্ধকালীন প্রধান মিত্র রাষ্ট্র ভারতের হাই কমিশনার এসব কথা বলেন।
বুধবার বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বাশার ঘাঁটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধকালীন ট্যাংক ও হেলিকপ্টার হস্তান্তর করেন ভারতের হাই কমিশনার। হস্তান্তরিত এসব যুদ্ধকালীন স্মারক বাহিনীর নিজ নিজ জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন-বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লে. জে. মো. নাজিমউদ্দীন, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সহকারী চিফ অফ এয়ার স্টাফ (প্রশাসন)এয়ার ভাইস মার্শাল এম. আবুল বাশার সহ সশস্ত্র বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে হাই কমিশনার শ্রিংলা বলেন, ‘বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের আরও কিছু স্মারক সশরীরে হস্তান্তর করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বিভিন্ন জাদুঘর এবং প্রতিষ্ঠানের অনুরোধের ভিত্তিতে করে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হস্তান্তর করা একটি চলমান উদ্যোগ’।
তিনি বলেন, ‘আপনারা স্মরণ করতে পারেন যে, ২০১৭ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক উপহার দিয়েছেন। স্মারকের মধ্যে ছিল-দুইটি পিটি-৭৬ ট্যাংক, একটি এমআই ৪ হেলিকপ্টার, ২৫টি অস্ত্র (পিস্তল, রাইফেল, মেশিন গান, মর্টার, রকেট লঞ্চার), অনেক সংখ্যক শিল্পকর্ম, ঐতিহাসিক ছবি, সংরক্ষিত অডিও ও ভিডিও ক্লিপিং, মানচিত্র, যুদ্ধের দলিল, পত্রিকার ক্লিপিং, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র।
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘অধিকাংশ স্মারক বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং এখন পিটি-৭৬ ও এমআই ৪ হেলিকপ্টারের মত বড় আকৃতির স্মারকগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। এগুলো তাদের নিজ নিজ জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে।’
হাই কমিশনার জানান, পিটি-৭৬ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আর্মার্ড রেজিমেন্টের হালকা ধরনের উভচর ট্যাংক। যুদ্ধের সময় নদী ও জলাশয় পারাপারে এই ট্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। গরীবপুরের বিখ্যাত যুদ্ধে এই ট্যাংকগুলির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। যে যুদ্ধে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এম৩৪ শ্যাফে ট্যাঙ্কসমৃদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল পরাজিত হয়েছিল। যুদ্ধের সময় উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলসমূহে পাকিস্তানি বাহিনীকে পিছু হটাতে এই ট্যাংকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
‘এমআই-৪ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর পরিবহন হেলিকপ্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলে যৌথ বাহিনী কর্তৃক আকাশপথে পরিচালিত অপারেশনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল এটি। দ্রুত সিলেট দখল করতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়নটি এই অপারেশনের জন্য সুরমা নদীর তীরে সিলেটের উপকণ্ঠে অবতরণ করেছিল। আবার ওই হেলিকপ্টারযোগেই ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রমত্তা মেঘনা নদীর চরে অবতরণ করেছিল ৩১১ পদাতিক ব্রিগেড। মেঘনা পাড়ি দিয়ে টানা ৩৬ ঘণ্টায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ১১০ বার হামলা চালানো হয়েছিল ওই হেলিকপ্টার থেকে। যৌথ বাহিনীর সেই অভিযান ‘মেঘনা হেলিব্রিজ’ নামে পরিচিত’-উল্লেখ করে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।
‘ভারতীয় বিমান বাহিনী একটি হান্টার জেট ফাইটার, একটি ডাকোটা পরিবহন বিমান এবং বর্তমানে এই এমআই ৪ হেলিকপ্টার উপহার দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ছয়টি ৩.৭ হাভিটজার (ছোট কামানবিশেষ) বন্দুক উপহার দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৫টি অস্ত্র ও পিটি ৭৬ ট্যাংক হস্তান্তর করা হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী আইএনএস বিক্রান্ত, যুদ্ধে অংশ নেয়া জাহাজের মডেল এবং সংরক্ষিত ছবি উপহার দিয়েছে’
হাই কমিশনার আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘স্মারকসমূহের প্রাপ্যতার উপর ভিত্তি করে এই ধরনের অনুরোধ পূরণের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমি নিশ্চিত যে, আজকে আমরা যে জিনিসগুলি হস্তান্তর করব তা সম্মান লাভ করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং একটি অভিন্ন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। ভারতে বাংলাদেশের অনেক সুখ্যাতি রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে লড়াই করে তাঁদের স্বাধীনতা অর্জন করেছে তার প্রশংসা করি আমরা। আমরা আপনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার সুযোগ পেয়ে গর্বিত। স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারত-বাংলাদেশের সৈন্য ও জনগণের সাহস, বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও গৌরবের সাক্ষ্য। এই উত্তরাধিকার এবং চেতনা আগামী দিনগুলোতে দুই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।’